Menu

আর্মি স্টেডিয়ামে ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব-২০১৬’ শুরু আজ

হাসনাত শাহীন
বহুকাল থেকেই ষঢ়ঋতুর এই দেশের বার মাসের তের পার্বন। প্রায় প্রতি মাসেই কোন না কোন পার্বনের আয়োজন থাকে। তবে ছয়ঋতুর দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা শেষেই শুরু হয়ে যায় নানান পার্বন-উৎসবের আয়োজন। শরতের এই মেঘ আর এই পরিচ্ছন্ন নীল আকাশের নিচের কাঁশফুলের শুভ্রতা মেখে অনুষ্ঠিত নানান আয়োজন ডেকে আনে ধানীসংস্কৃতির অন্যতম ‘নবান্ন উৎসব’ ; আসে উৎসবের মৌসুম ‘হেমন্ত’ ঋতু। এই হেমন্তের নতুন ধানের সোঁদাগন্ধ আর পিঠা-পুলির মৌ-মৌ গন্ধ মাখা হালকা শীতের হিমহিম হাওয়ায় দেশের আনাচে-কানাচে বসতে শুরু করে হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতির নানান অনুসঙ্গের নানান আয়োজন-উৎসব।

চলে শীত-বসন্ত ঋতু পর্যন্ত। বহুকাল থেকেই এই সময়ের কুয়াশার ছামিয়ানায় ঢাকা আকাশের তলে শীতের শুষ্কতার চাদর জড়ানো উত্তরের হিমেল হাওয়ার সন্ধ্যার পর গায়ে গরম কাপড় চাপিয়ে গান-বাজনার আসরে উপস্থিত হওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যার কারণে এই সময়ে সারাদেশেই বসে পরম সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক পরিম-লের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, লোকগানের আসর, যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজন-উৎসব-পার্বণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হযনি। গ্রাম-বাংলার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার নানা জায়গায় বসেছে এমনই নানা আয়োজন। উৎসবপ্রিয় বাঙালি সেসব উৎসবে হাজির হয়ে যেমন প্রমান করেছে ‘বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি’ তেমনই প্রতিটি আয়োজনকে করে তুলেছে প্রাণের মিলনমেলায়। আর এসব মিলনমেলার উচ্ছ্বসিত প্রাণের উদ্বেলিত দোলার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হতে যাচ্ছে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় প্রাণের উৎসব হয়ে ওঠা-‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব’। প্রতিবছরের মতো এবারও এই রাতভর শাস্ত্রীয় সুর আর ছন্দের পরশমাখা প্রহর শুরু হচ্ছে পুরনো সেই অনুষ্ঠানস্থল-যে জায়গাটা এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই শুধু ঢাকার মানুষের চেনা জায়গা থেকে পুরো বাংলাদেশের মানুষের চিরচেনা জায়গায় পরিণত হওয়া সেই ‘আর্মি স্টেডিয়াম’-এ।

‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’-এর আয়োজিত এবং ‘স্কয়ার গ্রুপ’ নিবেদিত এবারের এ আয়োজনের সব প্রস্তুতি শেষে আজ থেকে সেখানেই এবারও বসতে যাচ্ছে ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত শাস্ত্রীয় সংগীত ও ধ্রুপদী নৃত্যের এই মহাযজ্ঞ ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব-২০১৬’। প্রতিবছরের মতো এবারও এই উচ্চাঙ্গ সংগীতের ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পীরা পরিবেশন করবেন-রাগসংগীত। যন্ত্রশিল্পীরা রাগাশ্রয়ে বাজাবেন বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র। আর, বিশ্বের প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীরা তুলবে নাচের অনবদ্য ছন্দ। পৃথিবীখ্যাত এই সংগীত শাস্ত্রজ্ঞ-প-িত ওস্তাদদের কণ্ঠসংগীত-যন্ত্রসংগীত ও নৃত্যের ছন্দে আবারও মুখরিত হবে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়াম। উপমহাদেশের তো বটেই, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বর্ণাঢ্য এই শাস্ত্রীয়সংগীত উৎসবের বিশুদ্ধ সুর-ছন্দ আর তালে দেশের সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের ভালোলাগার অনন্যতায় জেগে উঠবে রাজধানী ঢাকার আকাশ-বাতাস।
দেশের বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা এবারের এ উৎসবের উদ্বোধনী দিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে বাংলাদেশের নৃত্যগুরু শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালনায় দলীয় নৃত্য পরিশেনের মধ্য দিয়ে। ‘রবি করোজ্জ্বাল’ শীরোনামের এই দলীয় নৃত্যে অংশ নিচ্ছে দেশের ‘নৃত্যনন্দন’ দলের ৬০ জন শিল্পী। আর এরই মধ্যে দিয়ে হবে-দেশের সংগীতপ্রিয় মানুষের প্রায় এক বছরের প্রতীক্ষার অবসান। এরপর দ্বিতীয় পরিবেশনায় যুগলবন্দির নানা স্বাদ পাওয়া যাবে শিল্পী প্রবীণ গোধকিন্ডি ও রাতিশ টাগডের সুরে বাঁশি ও বেহালায়।
বাঁশি ও বেহালার এই যুগলবন্দি শেষে সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হবে এবারের এ উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এ আয়োজনেই পাঁচদিনের শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর-ছন্দ আর নৃত্যের এই উৎসবের উদ্বোধন করবেন-অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ অনুষ্ঠানে এসময় বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামন নূর, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন। এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু।
এ উৎসবের মূল উদ্যোক্তা বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বলেন, ‘সঙ্গীতের অন্তঃপ্রাণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। প্রকৃত স্বাদটা পাওয়া যায় এই সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। এ ধারার সঙ্গীত এক সময় আমাদের দেশে সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু চর্চা ছিল খুবই কম। গত চার বছর ধরে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের আয়োজনের ফলে হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করেছে। দেশের মানুষের মধ্যে এই সঙ্গীত শোনান কান সৃষ্টি হয়েছে। শেখার আগ্রহ বেড়েছে। এ ধারা শিল্পী গড়ে উঠছে। কিছু কিছু শিল্পী এই উৎসবে অংশ নিচ্ছে। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক শিল্পীরাই উৎসব মাতিয়ে রাখবে। সেভাবেই গড়ে উঠছে একটা প্রজন্ম। সে দিন আরও বেশি দূরে নয়। সব মিলিয়ে এই আয়োজন নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।’
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা ও প্রবহমান সাংস্কৃতিক ধারাকে নবীন দৃষ্টিভঙ্গিতে সঞ্জীবিত করা এবং এই ধারার আলোকে চর্চা ও সাধনা অব্যাহত রাখাই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য। সাংস্কৃতিক চর্চার নানামুখী কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে জনরুচি, জীবন ও মননে মাত্রা সঞ্চার করতে আমরা প্রয়াসী। শাস্ত্রীয়সংগীতের সুবিশাল বিস্তৃতি ও বোধ আমাদের বিনীত করে, চেতনালোকে সঞ্চার করে কল্যাণ ও মঙ্গলবোধ। মানবিক হওয়ার সাধনায় নবীন মাত্রা যুক্ত করতেই বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পঞ্চমবারের মতো এই উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব আয়োজনে ব্রতী হয়েছি। তিনি আরও বলেন, ‘উপমহাদেশের মহাযজ্ঞের মঞ্চ প্রস্তুত। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা। এর পর শুধু সুরে ভেলায় ভেসে বেড়ানো পালা।’
উদ্বোধনী আলোচনা শেষে শুরু হবে প্রথমদিনের এ উৎসবের তৃতীয় পরিবেশনা। ভারতের বিদুষী গিরিজা দেবী পরিবেশন করবেন ‘খেয়াল’। এরপর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে বিশ্ববিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আলি আকবর খাঁয়ের নাতি ওস্তাদ আশিষ খাঁ পরিবেশন করবেন সরোদ। তার সঙ্গে থাকবেন বিখ্যাত তবলাবাদক প-িত বিক্রম ঘোষ। তাদের পরিবেশনার পর মঞ্চে আসবেন জয়পুর আত্রৌলির বিদুষী অশি্বনী ভিদে ও মেওয়াতি ঘরানার প-িত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর। তিনি পরিবেশন করবেন-জাসরাঙ্গি। প্রথম দিনের অধিবেশন শেষ হবে গ্রামি আওয়ার্ড নমিনি বিখ্যাত বেহালাবাদক পদ্মভূষণ ড. এল সুব্রহ্মণ্যনের বেহালা পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। তাকে তবলায় সঙ্গত করবেন প-িত তন্ময় বোস।
আজ থেকে আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই আয়োজন। এ উৎসবে প্রতিদিন অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। আর, প্রতিদিনই অনুষ্ঠান শেষ হবে ভোর ৫টায়। এ আয়োজনে বাংলাদেশ ও ভারতের আড়াই শতাধিক সঙ্গীতজ্ঞ এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের শিল্পী ১৬৫ জন। কণ্ঠে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি উপস্থাপিত হবে সেতার, সরোদ, সন্তুর, বাঁশি, বেহালা, খেয়াল, ম্যান্ডোলিন, একক তবলা বাদন, ওড়িষি ও কত্থক নৃত্য এবং কর্ণাটকী বাঁশি ও সংগীত। উৎসবের প্রবীততম শিল্পী ৮৭ বছর বয়সী বিদূষী গিরিজা দেবী। কনিষ্ঠতম শিল্পী ইসরাত ফুলঝুরি খান। বয়স সাত বছর।
শুধুমাত্র যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন তারাই উৎসব উপভোগ করতে পারবেন। যারা সঙ্গীত উপভোগ করতে আসবেন তারা কেন ধরনের ব্যাগ সঙ্গে আনতে পারবেন না। এবারের এ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আয়োজনে সমর্থন করছে ব্র্যাক ব্যাংক। সার্বিক সহযোগিতায় বেঙ্গল গ্রুপ। সম্প্রচার সহযোগী হিসেবে রয়েছে মাছরাঙা টেলিভিশন। অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার আইস মিডিয়া। আতিথেয়তা সহযোগী হিসেবে আছে র‌্যাডিসন হোটেল। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় বস্নুজ কমিউনিকেশনস। উৎসবে যোগদান এবং ফিরতে এবারও যানবাহনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
উৎসবে প্রবেশে দর্শক-শ্রোতাদের জন্য নিদের্শাবলী : পুরুষদের মোবাইল ফোন, ওয়ালেট ও চাবি ছাড়া অন্য কোন কিছু আনা যাবে না। মোবাইল ফোন, চাবি ও টাকা বহনের জন্য মহিলাদের ১০/ ৬ ইঞ্চির চেয়ে বড় ব্যাগ আনা যাবে না। নির্ধারিত সাইজের বড় ব্যাগ নিয়ে কোন ক্রমেই ভেন্যুতে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। উৎসবস্থলে স্থাপিত কোন কাউন্টারে ব্যাগ রাখারও কোনপ্রকার সুযোগ নেই। আয়োজকবৃন্দ ভেন্যুতে আনা কোনো ব্যাগের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না। বাইরের কোনো খাবার বা পানীয় নিয়ে ভেন্যুতে ঢোকা যাবে না। সব ধরনের তামাকজাতদ্রব্য, ম্যাচ, লাইটার বহন নিষিদ্ধ। অনুষ্ঠান সারা রাত চলবে কিন্তু রাত ১টায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। রাত ১টার পর ভেন্যুতে নতুন করে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। প্রবীণ ও অসমর্থদের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা শিথিলযোগ্য। ভেন্যুতে রেজিস্ট্রেশন করার কোন ব্যবস্থা থাকবে না। ভেন্যুতে প্রিন্টিং-এর কোন ব্যবস্থা থাকবে না।
প্রসঙ্গত, শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের ঐতিহ্যগত গঠন ও কৌশলের প্রতি সাধারণ শ্রোতাদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে গত বছরও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব সারাদেশের সঙ্গীতপিপাসুদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এবার তৃতীয়বারের মতো আরও বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজিত হতে যাচ্ছে এ উৎসব। ভারত থেকে আসছেন স্বনামধন্য গুণী শিল্পীরা। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ শাস্ত্রীয় সংগীতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং একই সঙ্গে শ্রোতা ও শিল্পী তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ২০১২ সালে উৎসবটি আয়োজন করা হয়।