চতুর্থ রাতে কর্ণাটকের মূর্ছনা
রাজধানীতে এখনো জেঁকে বসেনি শীত, তবে রাতের ঢাকায় রয়েছে হালকা শীতের আমেজ। এমন মৃদুমন্দ শীত আর কুয়াশামাখা রাতে মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে গিয়েছিল ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। গত রোববার রাত ছিল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিন। এ রাতে কত্থক নৃত্য, খেয়াল, কর্ণাটকের সংগীত আর সরোদ-তবলার যুগলবন্দিতে তৈরি হয় এক স্বপ্নিল আমেজ। মুনমুন আহমেদ আর তার দলের নৃত্য দিয়ে শুরু হয় দিনের আয়োজন।
এরপর একে একে হাজারো দর্শক-শ্রোতাকে সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ করেন নীলেশ রণদেব, জয়তীর্থ মেউ-ি, প-িত যোগেশ শামসি ও প-িত শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, রঞ্জনী সুব্রামনিয়াম ও গায়ত্রী সুব্রামনিয়াম, প-িত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার ও প-িত অজয় চক্রবর্তী।
তিন অংশে ত্রিতালে কত্থক নৃত্যতে হাজির হন মুনমুন আহমেদ তার দল রেওয়াজ-নিয়ে। শুরু করেন ‘ভিন্ন ষড়জে’ গুরুবন্দনা দিয়ে। এরপর একে একে আরো পরিবেশনায় জমিয়ে রাখেন শুরুর সন্ধ্যা। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ দেন তানজিলা করিম স্বরলিপি; বাঁশিতে ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সরোদে সুনন্দ মুখার্জী, এসরাজে অসিত বিশ্বাস, তবলায় সুবীর ঠাকুর। আবৃত্তি করেন অপরাজিতা মুস্তফা ও অহিদুজ্জামান। বেনারস ঘরানার কিংবদন্তি প-িত শান্তিলাল শাহের ছাত্র নীলেশ রণদেব আসেন এরপর। তবলায় তিনতাল বাজিয়ে মুগ্ধ করেন দর্শকদের, তাকে হারমোনিয়ামে সঙ্গ দেন মিলিন্দ কুলকার্নি।
এরপর মঞ্চে ওঠেন কিরানা ঘরানার শিল্পী জয়তীর্থ মেউ-ি; খেয়াল পরিবেশন করে শোনান রাগ শুদ্ধ কল্যাণ, আদানা ও নাট্যগীত। এ সময় তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি, হারমোনিয়ামে মিলিন্দ কুলকার্নি। পন্ডিত যোগেশ শামসি ও পন্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে আসেন তবলার যুগলবন্দি। তাদের তিনতালের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজান অজয় যোগলেকার।
এরপর আর্মি স্টেডিয়ামে নেমে আসে কর্ণাটকি কণ্ঠসংগীতের জাদু। দুই বোন রঞ্জনী সুব্রামনিয়াম ও গায়ত্রী সুব্রামনিয়াম একে একে গেয়ে শোনান ‘নাটাই-সরস্বতী’, ‘ত্যাগ রাজের’ কম্পোজিশনে রাগ ‘পন্তুবরালি’, তামিল কম্পোজিশনে ‘রাগ মুখারি’ এবং ‘রাগ খাম্বাজ’ (রাগাম তালাম পল্লবী) ও আদি ‘তালাম’।
তাদের সঙ্গে বেহালায় ছিলেন চারুমতি রঘুরমন, মৃদঙ্গমে কে সাই গিরিধর, ঘটম-এ ছিলেন চন্দ্রশেখর শর্মা। মন্ত্রমুগ্ধ এ মূর্ছনার শেষ হয় ‘বিটোভা চালা’ (রাগমালা) দিয়ে।
প-িত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার এবারো হাজির ছিলেন ধ্রুপদ সরোদ নিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে শাস্ত্রীয় সংগীতের এ আসরে নিয়মিত আসা তেজেন্দ্র এবার শুরু করেন ‘রাগ গুঞ্জি কানাড়া’ দিয়ে।
তারপর একে একে শোনান আলাপ জোড় ঝালা, বিলম্বিত তিনতালে ‘গৎ’। শেষে রাগ ‘যোগিয়া কালিংগ্রা’ বাজিয়ে শেষ করেন পরিবেশনা। এ সরোদগুরুর সঙ্গে তবলায় তাল দেন প-িত যোগেশ শামসি।
শেষ পরিবেশনা ছিল প-িত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল। ‘রাগ বিলাসখনি তরী’ ও ‘কুন্তল বাড়ালি’ পরিবেশনায় তাকে তবলায় সঙ্গত দেন সৌমেন সরকার, তানপুরায় অভিজিৎ কু-ু, হারমোনিয়ামে অজয় যোগলেকার। পাতিয়ালা-কসুর ঘরানার এ কিংবদন্তি শিল্পীর ‘রাগ ভৈরবী’ ভজন দিয়ে পর্দা নামে চতুর্থ দিনের।
প্রথম তিন দিনের মতো এদিনও দর্শকশ্রোতায় ভরপুর ছিল আর্মি স্টেডিয়াম; নানান ঘরানার বাদন আর সুরের জাদুতে সংগীতের রং-রূপ আর স্বাদ নিয়ে যখন তারা ফিরছিলেন ঘরে, পুবের আকাশে তখন পরের দিনের সূর্য।
উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিনের আয়োজন শুরু হবে সোমবার সন্ধ্যা ৭টায়। এবারের সমাপনী অধিবেশনের প্রধান অতিথি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক-বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। থাকবেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। এদিনের আয়োজনে থাকছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ ও বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের দলীয় সেতার। সন্তুর বাজাবেন প-িত শিবকুমার শর্মা, খেয়াল শোনাবেন পন্ডিত কুমার মারদুর ও আরতী আঙ্কালিকর; সেতার পরিবেশন করবেন প-িত কুশল দাস। কিংবদন্তী বংশিবাদক পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার ধুনে পর্দা নামবে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা এবারের উৎসবের।