Menu

ধ্রুপদী সুরে সারারাত্রি

thumbnail

শুদ্ধসঙ্গীতের আবির ছড়িয়ে শেষ হলো ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৬’। সেই সঙ্গে রচিত হলো পঞ্চরজনীর আরও কিছু গল্প। যে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছে কেবল সঙ্গীতপ্রেমীদের মুগ্ধতার বয়ান। রাগরাগিণীর খেলায় মেতে ওঠা কণ্ঠশিল্পী, বাদক ও নৃত্যশিল্পীরাও শুনিয়েছেন আশার কথা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই বর্ণাঢ্য আয়োজন এবং উপমহাদেশের খ্যাতিমান ও সম্ভাবনাময় শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা নিয়ে লিখেছেন রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ

ফিকে হয়ে এলো রাতের আঁধার। কাটল পঞ্চরজনীর ঘোর। রাগরাগিণীর ইন্দ্রজাল থেকে মিলল মুক্তি। ফিরে আসতে হলো উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সুর-ঝংঙ্কারে হারিয়ে যাওয়া কল্পলোক থেকে। নামল ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৬’-এর পর্দা। উৎসবের শেষ দিন, তাই মুগ্ধতার আবির রাঙানো মুখেও দেখা গেল বিষাদের ছায়া। মনে প্রশ্ন জাগল, এ উৎসব ছাড়া একসঙ্গে এত মন্ত্রমুগ্ধ আর বিষাদী মুখের দেখা মিলেছে কি? সঙ্গত কারণে উত্তর হবে- ‘না’। কেননা, ঢাকায় শুদ্ধ সঙ্গীতের এই বর্ণাঢ্য আসর বসে বছরে মাত্র একবার। সে জন্য এ উৎসবকে ঘিরে অগণিত সঙ্গীতপ্রেমী যেমন প্রতীক্ষার প্রহর গোনেন, তেমনি উৎসবে আগন্তুকরা সুরের ইন্দ্রজাল থেকে মুক্তি নয়; চান বন্দিত্ব। তার পরও কয়েক দর্শক-শ্রোতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের মাঝে এমন কী আছে, যা তাদের ভোররাত পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকার উৎসাহ জোগায়? উত্তরে দর্শকরা জানান, তাদের অনেকেই সঙ্গীতবোদ্ধা নন। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারেন, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে এমন এক সুধা আছে, যা অন্য কোনো সঙ্গীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঁশি-সরোদ-সেতার-বীণা-বাঁশি-বেহালা-সন্তুর-তবলা-তানপুরা-সারেঙ্গি-এস্রাজের মতো বাদ্যযন্ত্র অনবদ্য বাদনে মনের পর্দায় আপনাআপনি তৈরি করে কিছু চিত্রকল্প। অন্যদিকে চোখের পলক থামিয়ে দেয় ভরতনাট্যম-ওডিসি-কত্থকসহ সমস্ত শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা। সেই সঙ্গে ধ্রুপদ-খেয়াল-টপ্পা-ঠুমরি-দাদরা সুরের অনুরণন তুলে ঘোর লাগা আমেজ ছড়িয়ে দেয়। স্বেচ্ছায় তাই বন্দিত্ব বরণ করি। শুদ্ধ সঙ্গীতের আসরে তাই পাঁচটি রাত কেটে যায় সম্মোহিতের মতো। উৎসবের পর্দা টেনে দিলে মন কিছুটা বিষাদে ছেয়ে যায়। সেই সঙ্গে নতুন করে শুরু হয় প্রতীক্ষার প্রহর গণনা।

দর্শক-শ্রোতার মুখে এমন কথা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ দিন দিন দেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের কদর বেড়েই চলেছে। এবারও অর্ধলক্ষাধিক দর্শক-শ্রোতার মনে দাগ কেটেছে এ আয়োজন। শুদ্ধসঙ্গীতের মহীরুহদের পাশাপাশি এবারের আসরে নবীন শিল্পীরাও তাদের সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন।

উৎসবের প্রথম দিন থেকেই শিল্পীরা তাদের নান্দনিক পরিবেশনা তুলে ধরেছেন। উদ্বোধনী দিনে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় তার দল নৃত্যনন্দন পরিবেশন করে রবি ঠাকুরের ভাঙা গান আর মূল গান নিয়ে ‘রবি-করোজ্জ্বল নৃত্যমালিকা’। এ ছাড়া আরও কিছু শাস্ত্রীয় পরিবেশনা তুলে ধরেছে দলটি। নাচের পর দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন প্রবীণ গোদখিণ্ডি এবং রাতিশ। এ দুই শিল্পী বেহালা ও বাঁশির অনবদ্য যুগলবন্দি পরিবেশন করেন। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন শাস্ত্রীয় ঘরানার আরেক আলোচিত শিল্পী রামদাস পালসুল।

এর পর দর্শকের মনোযোগ কাড়তে ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেন সানাইয়ে সুর তোলেন। সেই সুরের রেশ কাটতে না কাটতে মঞ্চে ওঠেন বিদুষী গিরিজা দেবী। রাগ যোগকোষে খেয়াল পরিবেশন করেন তিনি। এর পর রাগ মিশ্র খাম্বাজে ঠুমরি, রাগ কাফিতে টপ্পা ও রাগ মিশ্র গৌরীতে দাদরা পরিবেশন করেন।

৮৭ বছরের এই প্রবীণ শিল্পীর পরিবেশনায় দর্শক যত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, এ আয়োজন নিয়ে তার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না এ শিল্পীর আনন্দের মাত্রা।

তিনি বলেন, ‘বাংলদেশের এ আয়োজন বারাবরই আমাকে মুগ্ধ করে। নিজেকের ধন্য মনে হয় এত অনুরাগীর সামনে গাইতে।’ এদিন গিরিজা দেবীর সঙ্গে গোপাল মিশ্র তবলা, মারাদ আলী খান সারেঙ্গি, সুমিত মিশ্র হারমোনিয়াম পরিবেশন করেন। কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন সুনন্দা শর্মা। প্রথম দিনের আয়োজনে আরও ছিল পণ্ডিত বিক্রম ঘোষের তবলায় ওস্তাদ আশিষ খানের সরোদ বাদন, বিদুষী অম্বিনী ভিদে ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্করের খেয়াল যুগলবন্দি ‘জাসরাঙ্গি, এল সুব্রহ্মণ্যনের বেহালা বাদন এবং পণ্ডিত তন্ময় বোস, আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদারের অনিন্দ্য তবলা বাদন।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বর্ণাঢ্য এ আসরের দ্বিতীয় দিনে ওডিসি নৃত্য পরিবেশন করেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগাল। খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর ও দেশের আলোচিত কণ্ঠশিল্পী প্রিয়াংকা গোপ। দলীয় তবলা পরিবেশন করেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ছিলেন কণ্ঠসঙ্গীতে মোহম্মদ শোয়েব ও তার শিক্ষার্থীরা। পণ্ডিত অভিজিৎ ব্যানার্জির তবলায় পণ্ডিত রনু মজুমদার ও ইউ রাজেশ শুনিয়েছেন বাঁশি আর ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি। তাদের পাশাপাশি পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকার ও সত্যজিৎ তালওয়ালকারের তবলা, রাহুল শর্মার সন্তুর, পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সেতার বাদন মনোযোগ কেড়েছে আর্মি স্টেডিয়ামে জমায়েত সঙ্গীতপ্রেমীদের। অন্যদিকে দর্শকের সরব উপস্থিতি দেখে মুগ্ধ বিদুষী মাধবী মুডগাল। তিনি বলেন, পৃথিবীর খুব কম দেশে এমন চিত্র চোখে পড়েছে। আমি আনন্দিত এমন একটি আয়োজনে অংশ নিতে পেরে। আমি জানি, নাচের কোনো ভাষার প্রয়োজন হয় না। আমি নিজেও ওড়িশি ভাষা জানি না। তার পরও শিল্পী হিসেবে ওড়িশি নাচকে বেছে নিয়েছি। বাংলাদেশের দর্শকের জন্য নাচের ভিন্নধর্মী পরিবেশনা তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছি। সঙ্গী নির্বাচন করেছি আরুশিকে। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার

আগ পর্যন্ত বুঝিনি, এদেশের দর্শক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের এতটা অনুরাগী! এ জন্য আরও অনেকবার এ উৎসবে আংশ নেওয়ার বাসনা রাখি।’

উৎসবের তৃতীয় দিন বাঁশির জাদুতে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন। খেয়াল পরিবেশনায় ছিলেন ওস্তাদ রাশিদ খান ও প্রভা আত্রে। এ ছাড়াও প্রতাপ আওয়াদের পাখোয়াজ বাদনের সঙ্গে ধ্রুপদ পরিবেশন করেন পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার। এর পাশাপাশি ছিল পরিমল চক্রবর্তীর তবলায় পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার বাদন। পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ তালওয়ালকার, অনুব্রত চট্টোপাধ্যায় ও রোহিত আত্রের তবলা বাদন ছাড়াও ছিল বেঙ্গল পরম্পরার সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীদের দলীয় সরোদ পরিবেশনা। চতুর্থ ও পঞ্চম দিনের আয়োজনও ছিল জমকালো। দেশের নন্দিত নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ ও তার দল রেওয়াজ-এর নৃত্য পরিবেশনা ছিল চতুর্থ দিনের বিশেষ আকর্ষণ। এ ছাড়াও পণ্ডিত যোগেশ শামসি ও পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তবলা যুগলবন্দি; রঞ্জনী ও গায়ত্রীর কণ্ঠসঙ্গীত যুগলবন্দি; পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের সারদ; জয়তীর্থ মেউন্ডি, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল; নীলেশ রণদেব ও আজিঙ্কা যোশির তবলা পরিবেশনা দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিল। পঞ্চম দিনের আয়োজন শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত দিয়ে। এর পর ছিল বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্র্থীদের সেতারের দলীয় পরিবেশনা। শেষ দিনে কুমার মাদুল, কুশল দাস, আরতি আঙ্কালিকারের পারিবেশনার পাশাপাশি সবার হৃদয় হরণ করেছিল পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুর এবং পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার অনবদ্য বাঁশি বাদন।

সব মিলিয়ে ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৬’ আশা-জাগানিয়া ছিল বলে মতপ্রকাশ করেছেন অনেকে। শিল্পীরাও ছিলেন উচ্ছ্বসিত।

পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াসহ অন্যান্য শিল্পীর আরও অনেকবার এমন আয়োজনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা সে কথারই প্রমাণ দেয়। তাদের পাশাপাশি শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রচার-প্রসার নিয়ে আশাবাদী কথা শোনান আয়োজকরা। তাদের কথায়, পাঁচ বছর ধরে আয়োজিত উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব এ দেশের দর্শক-শ্রোতার মনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। সে কারণেই এর দর্শক সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি।

এ কারণে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ধারাবাহিকভাবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব যেমন করবে, তেমনি সর্বস্তরের দর্শকের জন্য প্রতি বছর সঙ্গীতের রথী-মহারথীর পাশাপাশি সম্ভাবনাময় শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেবে। তাদের এ কথার রেশ ধরে বলা যায়, আগামীতে খুব কম সঙ্গীতপ্রেমীই বলবে_ এদেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তেমন প্রসার ঘটেনি। বরং তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখবেন শুদ্ধ সঙ্গীতে নতুনদের বিজয় কেতন ওড়ানোর।

বাংলাদেশও একদিন রাগ সঙ্গীতের অনবদ্য শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে- এমন কল্পনাও কারও কাছে অলীক বলে মনে হবে না। একটি উৎসবের সফল সমাপ্তির মধ্য দিয়ে আমরা এমন কথা ভাবতেই পারি।

View Full Article