Menu

ধ্রুপদী সুর লহরি

thumbnail

 

শুদ্ধসঙ্গীতের ইন্দ্রজালে বন্দি হওয়ার সময় এলো আবার। উপমহাদেশের খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী, বাদক ও নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৬’-এর আসর বসছে আজ। পঞ্চরজনীর এই আয়োজনে বাঁশি-বেহালা-সরোদ-সেতার-ম্যান্ডোলিন-বীণা-সন্তুর-তবলা-তানপুরাসহ নানা বাদ্যের অনিন্দ্য সুর ঝঙ্কারের পাশাপাশি থাকছে ধ্রুপদ-খেয়াল-টপ্পা-ঠুমরি এবং ভরতনাট্যম-ওডিসি-কত্থকসহ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পঞ্চম এই আয়োজন নিয়ে লিখেছেন রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ

এ সুরের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় কল্পলোকে। শ্রবণেন্দ্রিয় থাকে মুগ্ধতায় বিভোর। কখনও মনে হয়, এ যেন আবির ছড়ানো সুর-লহরি। রাগ-রাগিণীর মূর্ছনার সঙ্গে মিলিয়ে মনের ক্যানভাসে আঁকিয়ে নেয় নানা রঙের ছবি। হৃদয়ে অনুরণন তোলে বাঁশি-সরোদ-সেতার-বীণা-বাঁশি-বেহালা-সন্তুর-তবলা-তানপুরা-সুরবাহার-সারেঙ্গি-এস্রাজের অনবদ্য বাদন। ভরতনাট্যম-ওডিসি-কত্থকসহ সমস্ত শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা থামিয়ে দেয় পলক। ধ্রুপদ-খেয়াল-টপ্পা-ঠুমরি-দাদরা বন্দি করে নেয় ইন্দ্রজালে। স্বেচ্ছায় তাই বন্দিত্ব বরণ করি। সময় এলো আরও একবার সুরের সম্মোহনে ডুবে যাওয়ার। কেননা আজ থেকে শুরু হচ্ছে ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৬’। আবারও তাই দেখা মিলবে অর্ধলক্ষ সঙ্গীতপ্রেমীর মিলনমেলা। হাজার বছরে যার অমোঘ আকর্ষণ এড়ানো যায়নি, সেই শুদ্ধ সঙ্গীতের আসরে কাটবে আরও পাঁচ রজনী। রাত কেটে ভোর হবে সুরের আবির মেখে। কারণ পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত এবারের উৎসবেও থাকছে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা।

এরই মধ্যে অনেকে জেনে গেছেন ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনের এই উৎসবের খবরাখবর। তার পরও বলি, বর্ণিল এই সুরের আয়োজনে বাংলাদেশের ১৬৫ জন শিল্পী এবার অংশ নিচ্ছেন। আরও থাকছেন বেঙ্গলের পরম্পরা সঙ্গীতালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। উৎসবের বিভিন্ন দিনে সেতার, সরোদ ও তবলায় যন্ত্রসঙ্গীত এবং রাগসঙ্গীতের পরিবেশন তুলে ধরবেন তারা। বিশ্বের খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞদের সামনে নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরার জন্য এটি অনেক বড় একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন অনেকে। একই মত পোষণ করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা উৎসবের তিন দিন তবলা, সেতার সরোদ_ তিনটি মাধ্যমে তাদের পরিবেশনা তুলে ধরবে। এত বড় একটি উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য তারা অনেক পরিশ্রম করেছে। গুরুরাও তাদের পেছনে অনেক শ্রম দিয়েছেন। এ জন্য তাদের পরিবেশনা নিয়ে আমি আশাবাদী।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা সম্পর্কে আয়োজকরা জানান, উৎসবের শেষ দিন কণ্ঠশিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপের একক কণ্ঠের খেয়ালের সঙ্গে তার নির্দেশনায় থাকছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। এর আগে উৎসবের দ্বিতীয় দিন মোহাম্মদ শোয়েবের নির্দেশনায় তার শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করবেন পরীক্ষামূলক রাগসঙ্গীত। উৎসবে দেশের ১৬৫ জন শিল্পী অংশ নেবেন। উদ্বোধনী পর্বে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় নৃত্যনন্দন দলের ৬০ জন শিল্পীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গান ও ভাঙা গানে মণিপুরি, ভরতনাট্যম, ওডিসি ও কত্থক রীতির রূপায়ণ পরিবেশন করবেন। নাচের দ্বিতীয় আয়োজনে থাকছে মুনমুন আহমদ ও তার দলের কত্থক নৃত্য। চতুর্থ দিন দলটি তাদের পরিবেশনা তুলে ধরবে। খ্যাতিমানদের দলে এবার জায়গা করে নিচ্ছে বেঙ্গল পরম্পরার সাত বছর বয়সী শিল্পী ইসরাত ফুলঝুরি খান। উৎসবের কনিষ্ঠতম এই শিল্পী শোনাবে সেতার বাদন।

দেশি শিল্পীদের তালিকা বড় হলেও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা শিল্পীদের দলটিও একেবারে ছোট নয়। এর আগে যারা বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে অংশ নেননি_ এমন কিছু খ্যাতিমান শিল্পী অংশ নিচ্ছেন এবারের আসরে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বেহালাশিল্পী লক্ষ্মীনারায়ণ সুব্রামানিয়াম প্রথমবারের মতো এবারের উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। যিনি দেশীয় ধ্রুপদ সঙ্গীত ছাড়াও অর্কেস্ট্রা, ব্যালে ও চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। সেই সঙ্গে পেয়েছেন পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ সম্মাননা। তিনি ছাড়াও প্রথম অংশ নিচ্ছেন নন্দিত তবলাশিল্পী বিক্রম

ঘোষ। বঙ্গভূষণ খেতাবে ভূষিত এই শিল্পী বিশ্ববাসীর মনোযোগ কেড়েছেন ধ্রুপদী ফিউশন, রকসহ বিভিন্ন ঘরানার সঙ্গীতের সঙ্গে অনবদ্য তবলা বাদনে। উৎসব উপলক্ষে প্রথম ঢাকায় আসা শিল্পীদের দলে আরও আছেন মাধবী মুদগাল ও আরশি মুদগাল। তাদের পাশাপাশি সঙ্গীত পরিবেশন করবেন কিরানা ঘরানার শিল্পী প্রভা আত্রে। দাদরা, খেয়াল, ঠুমরি, গজলসহ নানা ধরনের সঙ্গীতে পারদর্শী এই শিল্পী এরই মধ্যে পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, কালিদাস সম্মাননা, একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। কর্ণাটকী কণ্ঠশিল্পী রঞ্জনি ও গায়ত্রীও প্রথম অংশ নিচ্ছেন বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে। এই সহোদর সঙ্গীতশিল্পীর একজন সঙ্গীত আরেকজন শোনাবেন বেহালা বাদন। তারা পণ্ডিত বালমুরালি কৃষ্ণ, টি বিশ্বনাথনসহ আরও বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে এক মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বিনয়চন্দ্র মুদগালের উত্তরসূরি মাধবী মুদগালও থাকছেন এবারের আসরে। ওডিসি নৃত্যধারার খ্যাতিমান এই শিল্পী উৎসবে তুলে ধরবেন তার অনবদ্য নৃত্যশৈলী। তার সঙ্গে থাকবেন একই ঘরানার তরুণ নৃত্যশিল্পী আরশি মুদগাল। তাদের পরিবেশনা নিয়ে আয়োজকরা বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও এমন কয়েকজন খ্যাতিমান শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যারা এর আগে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে অংশ নেননি। দর্শক-শ্রোতার কাছে তাদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা তুলে ধরার প্রয়াসেই ১৭ জন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আয়োজকদের এ কথায় ধরে নেওয়া যায়, হেমন্তের এই শীতল রাত দর্শক-শ্রোতাদের জন্য এবার কিছুুটা হলেও ভিন্ন রকম মনে হবে। কারণ এই শিল্পীদের পাশাপাশি থাকছেন আরও কয়েকজন বিশ্বনন্দিত শিল্পী, যাদের পরিবেশনা আরও একবার উপভোগ করার জন্য প্রতীক্ষায় আছেন অগণিত দর্শক। আশার কথা হলো, এবার তেমন কয়েকজন শিল্পী উপস্থিত থাকছেন এই উৎসবে। সে তালিকায় সবার আগে যার নাম আসে তিনি হলেন প্রবাদপ্রতিম বাঁশরিয়া পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তার বাশির জাদুতে দর্শক-শ্রোতা আরও একবার মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া আরও একবার শোনা যাবে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার মোহনীয় সন্তুরের সুর। ৮৭ বছরেও তিনি সমানতালে গাইতে পারেন, সে প্রমাণ দিতে ঢাকায় এসেছেন বেনারস ঘরানার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বিদুষী গিরিজা দেবী। খেয়াল, ঠুমরি ও টপ্পার পরিবেশনায় আবার দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করার আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। তার পাশাপাশি থাকছে কিংবদন্তি সঙ্গীতসাধক আলাউদ্দিন খাঁর বংশধর ওস্তাদ আশিষ খাঁর পরিবেশনা।

অন্যদিকে জাসরাঙ্গি যুগলবন্দি পরিবেশনায় অংশ নেবেন বিদুষী অশ্বিনী ভিদে ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর। বাঁশি ও ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি তুলে ধরবেন রনু মজুমদার ও ইউ রাজেশ। কণ্ঠ ও বাদ্যের নানা পরিবেশনা নিয়ে হাজির হবেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত উলহাস কশলকর, ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত কুশল দাস, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার। সব মিলিয়ে সঙ্গীত রথী-মহারথীদের এ এক বিশাল সমাবেশ। উৎসবটি সদ্যপ্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গ করা হয়েছে বলে আয়োজকরা জানান। অনুষ্ঠান আয়োজন সম্পর্কে তারা আরও জানান, প্রতিবছরের মতো প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলবে সুর-তাল ও লয়ের খেলার বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। দর্শকদের যাতায়াতের জন্য ভোর থেকে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দর্শক উৎসব উপভোগ করতে গিয়ে যেন কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হন, তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে।

পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে দেশের দর্শক-শ্রোতার আগ্রহ একেবারে কম নয়। সঙ্গীতবোদ্ধা না হয়েও তারা অনুভব করতে পারেন, এতে কী নির্যাস ছড়িয়ে আছে। এর আকর্ষণ কেন হাজার বছরেও ম্লান হয়নি, তা কিছুটা হলেও অনুভবের সুযোগ পান তারা। এ কথা কতটা সত্য তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিগত বছরগুলোয় উৎসবে অংশ নেওয়া দর্শকের কথায়। এবারের আয়োজনও তাই বর্ণাঢ্য হয়ে উঠবে_ এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

 

View Full Article