Menu

শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব নৃত্য-গীতে বিদ্যুৎ চমক

thumbnail আর্মি স্টেডিয়ামে মাধবী মুদগাল ও আরুশি মুদগালের ওড়িশি নৃত্য।

শাস্ত্রীয় নৃত্যের মুদ্রাগুলো চলছিল দ্রুতগতিতে। আর তা যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল দর্শকদের চোখ।

এ যেন এক স্বর্গীয় দ্যুতি! সুরের সম্মোহনে, নৃত্যের অনুরণনে শিল্পীদ্বয় যেন রচনা করছিলেন এক মহাকাব্যিক পটভূমি। বিদগ্ধ শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে, হতবাক করে ওড়িশি নৃত্যের ছন্দ-লয়ে একাটানা নেচে গেলেন বিদুষী মাধবী মুদগাল ও আরুশি মুদগাল। নিমেষেই নৃত্য-গীতে তৈরি হয়ে গেল অপূর্ব ঐকতান। গুণী দুই শিল্পীর ওড়িশি নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে গতকাল শুক্রবার শুরু হয় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবের দ্বিতীয় দিনের মূল আসর।
ছুটির দিনে গতকাল সন্ধ্যা ঠিক ৭টায় শুরু হয় এ রোমাঞ্চকর নৃত্য-ঝলক। ওড়িশি নৃত্যধারার খ্যাতিমান শিল্পী মাধবী মুদগাল। এ অঞ্চলে খানিকটা অপরিচিত ওড়িশি নৃত্য। তবে নৃত্যের মুদ্রা ও সুরের ব্যঞ্জনা বিদগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে তৈরি করে অন্য রকম ভালো লাগা। নৃত্য পরিচালনা ও কোরিওগ্রাফিতে গভীর বোধসঞ্চার এবং নিরীক্ষাধর্মী নৃত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ শিল্পী মাধবী মুদগালকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। তিনি ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নৃত্যকলা পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেছেন। স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাব, প্যারিসের ‘গ্রন্দ মেদাই দ্য লাভি দ্য পারি’ সম্মাননা।

উৎসবের শুরুতেই তাঁর ওড়িশি নৃত্যধারার ‘নটরাজ’ মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় শ্রোতাদের হৃদয়ে। বিদুষী মাধবী মুদগালের পর একই নৃত্যশৈলী নিয়ে মঞ্চে আসেন শিল্পী আরুশি মুদগাল। ওড়িশি নৃত্যধারার একজন প্রতিভাবান শিল্পী তিনি। কৌশলগত উৎকর্ষ ও মূলধারার নৃত্যে নতুন মাত্রা সংযোজনের জন্য সুনাম অর্জন করেছেন। আরুশি শিল্পী মাধবী মুদগালের ভ্রাতুষ্পুত্রী ও শিষ্য। পরে দুই শিল্পীর যুগল নৃত্য উৎসবের শুরুর পর্বটা করে তোলে মোহনীয় এবং বহু বর্ণিল।

পঞ্চ রজনীর এ উৎসবের দ্বিতীয় রাতে অগণন শ্রোতার আগমনে প্রাণবন্ত ছিল আর্মি স্টেডিয়াম। কখনো কণ্ঠে, কখনো যন্ত্রের সুর, তাল ও লয়ের মায়াবী মূর্ছনায় সিক্ত হয়েছে অগণন শ্রোতা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এবং স্কয়ার নিবেদিত পঞ্চমবারের উৎসবের দ্বিতীয় রাতে এমন নয়ন জুড়ানো দৃশ্যের দেখা মিলেছে। রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শ্রোতার সংখ্যা। এ রাতের আয়োজনে দেখা মিলেছে চোখ জুড়ানো ওড়িশি নৃত্য, শোনা গেছে হৃদয় উচাটন করা তবলার বাদন, সন্তুরের সুমধুর সুর, সেতারের স্নিগ্ধ শব্দধ্বনি, বাঁশি ও ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি পরিবেশনা এবং মোহময় খেয়ালের সুর।

ওড়িশি নাচ শেষ হতেই বেজে ওঠে সম্মিলিত তবলার বাদন। মঞ্চে আসেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের নবীন শিল্পীরা। এই তবলিয়া দলে ছিলেন চিন্ময় ভৌমিক, ফাহমিদা নাজনিন সুমাইয়া, এম জে জে ভুবন, নুসরাত-ই-জাহান খুশবু, পঞ্চম সান্যাল, প্রশান্ত ভৌমিক ও সুপান্থ মজুমদার। এই তবলিয়াদের পরিবেশনাটিও প্রশংসা কুড়িয়েছে সবার।

তবলার বাদন শেষে খেয়াল শোনান বাংলাদেশের শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। তবলায় তাঁকে সংগত করেন ইফতেখার আলম প্রধান। প্রিয়াঙ্কা গোপ শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন পুরো পরিবেশনাতেই। ইফতেখার আলম প্রধান বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত তবলাশিল্পী। ২০১৬ সালে ইফতেখার লন্ডনের প্রখ্যাত রয়েল অ্যালবার্ট হলে ‘অ্যা ক্লাসিক্যাল অডিসি : ট্রিবিউট টু রবিশঙ্কর’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পীদের সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে তবলা পরিবেশন করেন।

দ্বিতীয় রজনীর অন্যতম আকর্ষণ রাহুল শর্মার সন্তুর পরিবেশনা। সন্তুরের শ্রুতিমধুর সুর যেন আরো একধাপ ছাপিয়ে যায় শিল্পীর অনবদ্য পরিবেশনায়। কণ্ঠসংগীত ও সন্তুর বাদনে রাহুল শর্মার হাতেখড়ি তাঁর বাবা প্রবাদপ্রতিম সংগীতবেত্তা পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার কাছে। তিনি রিচার্ড ক্লেডারম্যান, কার্সি লর্ডসহ খ্যাতিসম্পন্ন বহু গায়ক ও বাদকের সঙ্গে একই মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেছেন। রাহুল শর্মাকে তবলায় সংগত করেন আরেক জনপ্রিয় তবলিয়া সত্যজিৎ তালওয়ালকার। বাবা স্বনামধন্য তবলিয়া পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকার ও মা বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকারের কাছে সত্যজিৎ তালওয়ালকারের হাতেখড়ি। বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি একজন চৌকস তবলাশিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। ওয়ার্ল্ড মিউজিক, ফিউশন ও জ্যাজেও তাঁর আগ্রহ অনেকেরই জানা। লুই ব্যাংকস ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পারকাশনিস্ট ত্রিলোক গুর্তুর সঙ্গে তিনি একই মঞ্চে বাজিয়েছেন।

দলীয় কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ শোয়েব ও অন্যরা। এ সময় তবলায় ছিলেন ইফতেখার আলম প্রধান ও পাখোয়াজে সুষেন কুমার রায়।

সেতারে সুর ছড়ান পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ভারতের প্রখ্যাত এই সেতারবাদক সেনিয়া মাইহার ঘরানার আবহে কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। শঙ্কর মহাদেবন ও ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে যুগল পরিবেশনা করেছেন অনেকবার।

এ উৎসবের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী পণ্ডিত উল্লাস কশলকর। তিনি খেয়াল পরিবেশন করেন। তাঁকে তবলায় সংগত করেন সুরেশ তালওয়ালকার। পণ্ডিত উল্লাস কশলকরের হাতেখড়ি তাঁর বাবা এন ডি কশলকরের কাছে। পণ্ডিত রাম মারাঠে ও পণ্ডিত গজাননবুয়া যোশির কাছে তিনি তালিম নেন। বর্তমানে গোয়ালিয়র, জয়পুর ও আগ্রা ঘরানার একজন ধারক ও বাহক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয়। উচ্চাঙ্গসংগীতে অবদানের জন্য উল্লাস কশলকর পদ্মশ্রী, যদু ভট্ট পুরস্কার, স্বররত্ন পুরস্কার ও সংগীত নাটক আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। জগত্গুরু শঙ্করাচার্য তাঁকে গানতপস্বী খেতাবে ভূষিত করেছেন।

দ্বিতীয় রাতের আরেক আকর্ষণ ছিল পণ্ডিত রনু মজুমদারের বাঁশি ও ইউ রাজেশের ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি পরিবেশনা। রনু মজুমদার ভারতের একজন প্রতিষ্ঠিত বংশীবাদক। তাঁর প্রকৃত নাম রনেন্দ্রনাথ মজুমদার। তবে রনু মজুমদার নামেই তিনি বেশি পরিচিত। মাইহার ঘরানার এই বাদ্যশিল্পী আর্ট অব লিভিং অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে পাঁচ হাজার ৩৭৮ জন বংশীবাদককে উপস্থাপন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিষয়টি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। আর ইউ রাজেশ ভারতের একজন বিশিষ্ট ম্যান্ডোলিন শিল্পী। ম্যান্ডোলিনের স্বনামধন্য শিল্পী ইউ শ্রীনিবাসের ভ্রাতা ইউ রাজেশ তাঁর বাবা ও ভাইয়ের কাছে তালিম নেন। জন ম্যাকলফলিনের অ্যালবাম ‘ফ্লোটিং পয়েন্টে’ ম্যান্ডোলিন বাদনের জন্য গ্র্যামি পদকের জন্য তিনি মনোনয়ন লাভ করেছিলেন। এভাবে ম্যান্ডোলিন আর বাঁশির মধুর পরিবেশনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের দ্বিতীয় রজনীর পরিবেশনা। একটু পরেই রাজধানীর বুকে নেমে আসে প্রথম দিনের মধ্যরাতের আয়োজন : গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে উৎসব মঞ্চে সরোদ বাজিয়ে মুগ্ধ করেন ওস্তাদ আশীষ খান। শুরুতেই তিনি রাগ দরবারি কানাড়ায় আলাপ জোড় ঝালা বাজিয়ে শোনান। এরপর রাগ চন্দ্রনন্দন ও মিশ্র ভৈরবী রাগ পরিবেশন করেন। তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করেন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ ও সরোদে ছিলেন সিরাজ আলী খান। এরপর খেয়াল যুগলবন্দি ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করেন বিদুষী অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর। অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে রাগ ললিত ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর পুরিয়া ধানেশ্রী পরিবেশন করেন একই সঙ্গে। এরপর রাগ দুর্গা পরিবেশন করেন অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে এবং সঞ্জীব অভয়ংকর পরিবেশন করেন রাগ ভূপালি। তাঁদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার। হারমোনিয়ামে সহযোগিতা করেন মিলিন্দ কুলকার্নি ও তন্ময় দোচাকি। রাতের শেষ প্রহরে বেহালা পরিবেশন করেন ড. এল সুব্রহ্মণ্যন। শুরুতেই তিনি আদি তালাম বাজিয়ে শোনান। তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করেন পণ্ডিত তন্ময় বোস। এরপর তিনি আদি তালাম মোহানাম এবং নিজস্ব সৃষ্টি ছন্দপ্রিয়া পরিবেশন করেন। তাঁর সঙ্গে ঘটমে ছিলেন টি এন রাধাকৃষ্ণান ও মৃদঙ্গমে লক্ষ্মীনারায়ণ রঘুনাথান।

আজকের পরিবেশনা : আজ শনিবার উৎসবে তৃতীয় দিনের পরিবেশনা শুরু হবে বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের দলীয় সরোদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। বাঁশি বাজিয়ে শোনাবেন শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন। তাঁর সঙ্গে মৃদঙ্গমে থাকবেন পারুপল্লী ফাল্গুন, তবলায় সত্যজিৎ তালওয়ালকার। খেয়াল পরিবেশন করবেন ড. প্রভা আত্রে। তাঁর সঙ্গে তবলায় থাকবেন রোহিত মজুমদার। তবলা বোলে মাত করবেন পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার পরিবেশন করবেন ধ্রুপদ। সেতার বাজিয়ে শোনাবেন পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবলায় থাকবেন পরিমল চক্রবর্তী। ওস্তাদ রশিদ খানের খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তৃতীয় দিনের পরিবেশনা। তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করবেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

View Full Article