Menu

শেষ হলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব চৌরাসিয়ার মন্ত্রমুগ্ধ বাঁশিতে ভোর

হাসনাত শাহীন

‘ওই তো বেজেছে তব প্রভাতের বাঁশি/আনন্দ উৎসবে ভরা! সূর্যকর রাশি’-তোমার সর্বাঙ্গে আজ আনন্দে লুটায়,/উজল উছল জলে কুসুম ফুটায়!…/তোমার সঙ্গীত আজি বিহঙ্গের প্রায়, মাখি সে সোনার স্বপ্ন তার সর্ব গায়,/উড়িয়া বেড়ায় মোর হৃদয় আকাশে,/প্রেমের তরঙ্গে আর বসন্ত বাতাসে!- চিত্তরঞ্জন দাশ-এর ‘সাগর সঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতার কথামতো এখন বসন্ত নয়, হেমন্ত। এই হেমন্তের শিশির স্নাত অনুপম হিমেল হাওয়ার হালকা শীতের ভোর ভেসে ভেসে গেল উদাস করা বাঁশির সুরে সুরে বসন্তের উদাসী হাওয়ার প্রভাতের কোলে। বিশ্বের খ্যাতিমান বংশীবাদক পন্ডিত ‘হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া’র সেই বাঁশির সুরের অনন্য-অতলের মুগ্ধতায় ভেসে ভেসে উদাসী হলো রাত ভোর ঘুম ভুলে অপেক্ষায় থাকা হাজার হাজার শ্রোতা। গতকাল রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে রাত শেষে হেমন্তের প্রভাতের আগেই ভোরের প্রারম্ভেই চৌরাসিয়ার বাঁশি বাদন শুরু হলেই দেশের নানা প্রান্তে থেকে আসা সুরপিয়াসীদের ভাঙে দীর্ঘ এক বছরের অপেক্ষা। আর, বিশ্বখ্যাত এই বংশীবাদকের অনন্য বংশীবাদনে ভোর-প্রভাত হলেই শুরু হয় আবারও অপেক্ষার পালা। এই এক বছরের জন্য এমনই মধুর অপেক্ষার শুরুর মাধ্যমেই ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব-২০১৬’ শেষ হলো।
দেশের বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গ করা পাঁচ দিনব্যাপী এই বার্ষিক বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিনের অনুষ্ঠানের ভোরের সূচনালগ্নে সবশেষ আয়োজনে হিসেবে ছিলো-পন্ডিত ‘হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া’র বাঁশি। চৌরাসিয়ার বাঁশির আগে পন্ডিত শিব কুমার শর্মার সন্তুরের অনবদ্য পরিবেশনা মুগ্ধ করে রাত জেগে থাকার এবারের এ আবহকে। এর আগে হেমন্তের সন্ধ্যা থেকে রাত গড়িয়ে ভোর পর্যন্ত রাজধানীতে বইয়েছে মন উচাটন করা হালাকা শিশিরস্নাত সুরের হালকা হিমেল বাতাস। সুর-তাল ও লয়ের মায়াবি টানে আর্মি স্টেডিয়ামে ভিড় জমে ছিলো-কয়েক হাজার হাজার সঙ্গীতানুরাগী। সাজবেলা থেকে ভোর পর্যন্ত সুরের অনুরণনে সিক্ত হচ্ছে শ্রোতাকুল। সঙ্গীতের মহাযজ্ঞে কেমন করে যেন কেটে যাচ্ছে নির্ঘুম রাত। আর এমন নির্মল আনন্দময়তার উৎস-পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি’র সুরের সাথে ভোরের রক্তিম সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য আর হেমন্তের ভোরের শিশিরে অবগাহন। গত ২৪ নভেম্বর দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নৃত্যনন্দনের ‘রবি করোজ্জ্বল’ শিরোনামের নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসবটি শেষ হয়-আজ (২৯ নভেম্বর) ভোর পাঁচটায়।
পঞ্চম দিনের এই উৎসবটির শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীদের ভূপালী রাগে দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে। শিল্পীদের তবলায় সঙ্গত করেন স্বরূপ হোসেন ও জাকির হোসেন। তাদের এ পরিবেশনা শেষে দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। তারা পরিবেশন করেন রাগ চারুকেশী। এই দলে ছিলেন নিশিত দে, সাম্য দে, আশিস নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিৎ ম-ল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টিএম সেলিম রেজা, খন্দকার নাজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জী, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ, মো. কাওছার প্রমুখ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দেশের শিল্পীরাও যে এগিয়ে যাচ্ছেন, তা-ই বোঝা গেলো তাদের পরিবেশনায়।
এরপরেই শুরু হয় এবারের এ উৎসবের সমাপনী আয়োজন। এই আয়োজনের শুরুতেই আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট ও আয়োজনকে স্বার্থক করে তোলার জন্য প্রশাসন ও সঙ্গীত প্রিয় দেশের মানুষদের ধ্যনবাদ জানান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু। তার ধ্যনবাদ জ্ঞাপনের আগে প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক ও গত বছরের এই আয়োজনে সঙ্গীত পরিবেশনকারী ভারতের দুজন সঙ্গীতজ্ঞর প্রতি এবং রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান হোটেলে নিহত পুলিশ প্রশাসন ও অন্যান্যদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ আয়োজনে বেঙ্গল ফান্ডেশনের ট্রাস্টি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। এছাড়াও এতে অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
সমপানী আয়োজন শেষে মঞ্চে আসেন পন্ডিত শিব কুমার শর্মা। পন্ডিত শিব কুমার শর্মার হাতের ছোঁয়ায় সন্তুরের সুরে ছড়িয়ে পড়ে অপূর্ব মূর্ছনা। কাশ্মিরী লোকসঙ্গীতে ব্যবহৃত হয় সন্তুর। পন্ডিত শিব কুমার শর্মা সন্তুর বাদনে দিয়েছেন নতুন মাত্রা।
সন্তুরের পর খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন কুমার মারদুর। কুমার মাদুর ধারাওয়াড় গায়নরীতির একজন কুশলী কণ্ঠশিল্পী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি।
অনুষ্ঠানের এ পর্বে সেতার পরিবেশন করেন পন্ডিত কুশল দাস। তিনি ভারতের একজন বিশিষ্ট সেতার ও সুরবাহার শিল্পী। সেতারের তারে তারে সুরের ধারা বইয়ে দেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন পন্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
এবারের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবে প্রায় প্রতিদিনই ছিল খেয়াল পরিবেশনা। সমাপনী দিনেও ছিল খেয়াল। গতরাতে খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতী আঙ্কালিকার। সুকণ্ঠী এই গায়িকার তাল ও সুরের চমৎকার খেলা এক মোহময় আবহের সৃষ্টি করে। তবলায় সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার।
পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরি বাঁশির সুরে শেষ হয় এই উৎসব। তিনি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। ভারত সরকার তাকে পদ্মবিভূষণ, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার ও ন্যাশনাল এমিনেন্স অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে। ডাচ রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অফ ওরাঞ্জন্যাসো’ খেতাব এবং ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে নাইট উপাধি লাভ করেছেন। তিনিই ছিলেন সমাপনী দিনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের এবারের আসর নিবেদন করেছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক।