Menu

সুর মূর্ছনায় স্পন্দিত রাত

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই পাল্টে যাচ্ছে আবাহনী মাঠের দৃশ্যপট। দল বেঁধে মাঠে প্রবেশ করছে অসংখ্য মানুষ। হুড়োহুড়ি নেই। টিকিট নিয়ে কালোবাজারিও নেই। মানুষ আসছে ‘খেলা’ দেখতে। তবে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা নয়। খেলাটা সুরের। সুর নিয়েও শিল্পীরা মোহময় খেলায় মেতে উঠতে পারেন, আর দর্শক-শ্রোতারা তা দেখে বিমোহিত হন—আবাহনী মাঠে না এলে তা উপলব্ধি করা মুশকিল। এখানে সুরের মূর্ছনায় রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়, সুরের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে শ্রোতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে শেখ কামাল আবাহনী মাঠে সুরের মূর্ছনায় স্পন্দিত হয়ে উঠেছিল বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের তৃতীয় রাত।

পৌষের কুয়াশার সঙ্গে আবাহনী মাঠের আলো-আঁধারি মিশে সমাচ্ছন্ন ছিল গতকাল সন্ধ্যার পরিবেশ। শীতের হাওয়ায় ভাসছিল সরোদ, সেতার, ঘাটম ও কঞ্জিরা, বাঁশি ও কণ্ঠমাধুীর সম্মোহনী সুর। সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে যায় সেতারের ঝংকার। বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা সেতারে মায়াবী সুর তুলে পরিবেশকে করে তোলেন মোহময়। সুর-রসিকদের প্রত্যাশাকেও যেন ছাপিয়ে যায় তাঁদের পরিবেশনা। বাংলাদেশ ফিরে পাচ্ছে উচ্চাঙ্গসংগীতের হারানো গৌরব—সেই বার্তাই যেন উপহার দিলেন পণ্ডিত কুশাল কুমার দাশের শিষ্যরা। এ সময় সেতারে শিল্পীরা পরিবেশন করেন রাগ কিরওয়ানি। পরিবেশনায় অংশ নেন প্রসেনজিৎ মণ্ডল, টি এম সেলিম রেজা, রিংকো চন্দ্র দাস, মেহরীন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জি, মোহাম্মদ কাওসার ও জাহাঙ্গীর আলম।

দ্বিতীয় পরিবেশনায় ছিল ঘাটম ও কঞ্জিরার যুগলবন্দি। ঘাটম বাজিয়ে শোনান ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়ক রাম ও কঞ্জিরা শোনান শিল্পী সেলভাগণেশ বিনায়ক রাম। মাটির পাতিল দিয়ে তৈরি অদ্ভুত সুরেলা যন্ত্র ঘাটম। তবলার মতো তাতে ওঠে বোল। দুই পাশে বড় আকারের চারটি মাটির ঘাটম নিয়ে মঞ্চে ওঠেন গ্র্যামিজয়ী প্রবীণ শিল্পী বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়ক রাম। সঙ্গে কঞ্জিরা বাজান শিল্পী সেলভাগণেশ বিনায়ক রাম। ঘাটম ও কঞ্জিরার যুগলবন্দিতে জমে ওঠে তৃতীয় রজনীর উৎসব।

এর পর খেয়াল পরিবেশন করেন সরকারি সংগীত কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ১৮ সদস্যের এই দলে ছিলেন আশা খন্দকার, বিটু কুমার শীল, দেবজানি দাস, ড. ফকির সুমন, জি এম সাইফুল ইসলাম, জোহরা হোসাইন, মল্লিকা ওঝা, গোলাম মোস্তফা, মমিন মিয়া, মুরাদ হোসাইন, নিউটন বৈরাগী, নিত্য গোপাল ঠাকুর, অর্বি শর্মি, শারমিন সুলতানা স্মৃতি, কৃষ্ণ গোপাল, সুমা ব্যাপারী, সুস্মিত সাহা ও তমালিকা হালদার।

খেয়ালের পরিবেশনা শেষে সরোদ বাজিয়ে শোনান ভারতের প্রখ্যাত সরোদ শিল্পী আবির হোসেন। এরপর বাঁশিতে সুর তোলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান বাঁশরিয়া গাজী আবদুল হাকিম। বাঁশির সুর থামতেই মঞ্চে আসেন ভারতের পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর। বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের এই শিক্ষকের পরিবেশনায় ছিল ধ্রুপদ। তাঁর কণ্ঠের মাধুর্যে মাঠে সৃষ্টি হয় এক অনন্য পরিবেশ। তিনি মঞ্চ থেকে নামতেই বেহালা হাতে মঞ্চে আসেন ভারতের বিদুষী কালা রামনাথ। তৃতীয় দিনের শেষ পরিবেশনায় খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। তাঁর কণ্ঠমাধুরীর অপূর্ব ব্যঞ্জনায় শেষ হয় তৃতীয় রজনীর পরিবেশনা। ততক্ষণে রাত পেরিয়ে ভোর। সুরের মাধুর্য নিয়ে ঘরে ফেরে সংগীতপিয়াসীরা। এবারের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল আই, মেডিক্যাল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, ইভেন্ট ব্যবস্থাপক ব্লুজ কমিউনিকেশনস এবং আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়। সার্বিক সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরের পারফেক্ট হারমনি।

বুধবার মধ্যরাতের পরিবেশনা :  উৎসবের দ্বিতীয় দিন বুধবার মধ্যরাতে খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর। প্রথমে তিনি পরিবেশন করেন রাগ যোগকোষ, পরে গেয়েছেন সোহিনী রাগ। তাঁর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন সুরেশ তলওয়ালকার। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এরপর সেতার পরিবেশন করেন ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খাঁ। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন অভিজিৎ ব্যানার্জি। তিনি শোনান বাগেশ্রী রাগ। পরিবেশনা শেষে শাহিদ পারভেজ খাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। এরপর বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিত কুণ্ডু পরিবেশন করেন ধ্রুপদ। শিল্পীকে পাখোয়াজে সঙ্গত করেন সুখাদ মুণ্ডে, তানপুরায় ছিলেন জ্যাতাশ্রী রায় চৌধুরী ও টিংকু কুমার শীল। অভিজিত কুণ্ডু পরিবেশন করেন রাগ বেহাগ। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি শাহ সৈয়দ কামাল। দ্বিতীয় দিনের আয়োজন শেষ হয় পণ্ডিত রণু মজুমদারের বাঁশি এবং পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোসের সরোদের যুগলবন্দি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। তাঁদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন যোগেশ সামসি এবং অভিজিৎ ব্যানার্জি। শিল্পীদ্বয় পরিবেশন করেন রাগ আহীর ভৈরব। শেষে দর্শকদের অনুরোধে তাঁরা ভাটিয়ালি ধুন পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে তাঁদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

আজকের আয়োজন : উৎসবের চতুর্থ দিন আজ শুক্রবার। ছুটির দিনে আজ শুরুতেই থাকবে ধ্রুপদি নৃত্যের ঝংকার। মণিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবেন সুইটি দাস, অমিত চৌধুরী, স্নাতা শাহরিন, সুদেষ্ণা স্বয়মপ্রভা, মেহরাজ হক ও জুয়াইরিয়াহ মৌলি। দ্বিতীয় পরিবেশনায় অংশ নেবেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা পরিবেশন করবেন সরোদ। তৃতীয় পরিবেশনায় অংশ নেবেন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রশিদ খান। তিনি খেয়াল পরিবেশন করবেন। পর্যায়ক্রমে সরোদ পরিবেশন করবেন পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, বেহালা শোনাবেন ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ, খেয়াল পরিবেশন করবেন পণ্ডিত যশরাজ। চেলো শোনাবেন সাসকিয়া রাও দ্য হাস। সব শেষে ভোরে সেতারে সুর তুলবেন পণ্ডিত বুদ্ধাদিত্য মুখার্জি।

 

View Full Article