Menu

আজ শুরু হচ্ছে উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব শুদ্ধ সংগীতের শিকড় বাংলাদেশেই

পঞ্চমবারের মতো আজ সন্ধ্যায় শুরু হচ্ছে বিশ্বের সব থেকে বড় উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। চলবে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত। এ উৎসব নিয়ে গতকাল কথা বললেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। জানালেন তাঁর স্বপ্ন ও সেগুলো বাস্তবায়নের নানা কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল মাহ্‌মুদ

প্রথম আলো: বিশ্বের সব থেকে বড় উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের স্বপ্নটি কীভাবে পেলেন?

আবুল খায়ের: ইউরোপে দেখেছি এক-দেড় হাজার লোক নিয়ে ছোট ছোট কনসার্ট হয়। চেম্বার কনসার্ট বলে সেগুলোকে। বাংলা গানের উৎসব দেখেছি। আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চাটা প্রায় হয়ই না। তবে ঢাকার বাইরে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। রাজশাহী, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছোট পরিসরে এখনো ঘরে ঘরে শুদ্ধ সংগীতের চর্চা হয়।

ভারতে ছোট পরিসরে উচ্চাঙ্গসংগীতের উৎসব হয়। সেগুলোতে আড়াই বা তিন হাজার মানুষ হয়। খেয়াল করে দেখলাম, এসব উৎসবকে পরিচিত করানোর জন্য যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই শিকড় বাংলাদেশে। বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, আলী আকবর খাঁ সাহেব, রবিশঙ্কর, উদয় শংকর, নিখিল ব্যানার্জি, অজয় চক্রবর্তী, বেলায়েত খাঁ, ইমদাদ খাঁ সাহেব—এঁরা সবাই বাংলাদেশের। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে–পরে তাঁরা ভারতে চলে যান। আমার মনে হলো, আমাদের রক্তের ভেতরেই এই সংগীত প্রবহমান। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যদি শুদ্ধ সংগীতে আগ্রহী করা যায়, তাহলে অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা সফল হবে।

প্রথম আলো: একে জনপ্রিয় করার ভাবনাটা কীভাবে এল?

আবুল খায়ের: চিন্তা করলাম, একই প্ল্যাটফর্মে চার বা পাঁচ দিন ধরে যদি এই সংগীতের একটা উৎসব করা যায়, কেমন হয়? মতি ভাইকে (প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান) বললাম, তিনি উৎসাহ দিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা করতে পারলে কিছু একটা হবে। তিনিই পরামর্শ দিলেন নিবন্ধনের মাধ্যমে দর্শককে সম্পৃক্ত করতে। স্টেডিয়ামের মতো বড় জায়গায় ক্ল্যাসিক্যাল ফেস্ট হতে পারে, এভাবে কেউ চিন্তাই করতে পারেনি।

প্রথম আলো: ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু বলুন।

আবুল খায়ের: সে সময় ফরহাদ নামের একজন আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করল। ইভেন্ট ম্যানেজ করত। তার কথাও মতি ভাই-ই বলেছিলেন। খুব দক্ষ,
নিবেদিতপ্রাণ, সৎ। সে এই উৎসবের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিল। আমি তিনটি শর্ত দিলাম। এক. কোনো ময়লা থাকা চলবে না, দুই. এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেটা দেখেই মানুষ আনন্দিত হয়, তিন. মানুষ অনেকক্ষণ এখানে থাকবে, যেন ফুড কোর্ট থাকে।

শুরুতে আমাদের এ উৎসব নিয়ে সবাই হেসেছিল। শিব কুমার শর্মাই বলেছিলেন, কোন পাগল বাংলাদেশ থেকে এসেছে, স্টেডিয়ামে ক্ল্যাসিক্যাল ফেস্ট করবে। এক হাজার লোকও হবে না, তবে যাব। এখন প্রতিবছরই লোক বাড়ছে। আমাদের ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হচ্ছে।

প্রথম আলো: উৎসবকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য কী করেছেন?

আবুল খায়ের: মনে হলো, এত লোক যেহেতু আসছেন আমরা একটা স্কুল করব না কেন? সরকারকে অনুরোধ করে স্কুলের অনুমতি নেওয়া হলো। করলাম, ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’, ১৬ জন গুরুকে এর সঙ্গে যুক্ত করা হলো। উলহাসজি (পণ্ডিত উলহাস কাশালকার) খুব নামকরা একজন শিল্পী, তিনি আমাদের অধ্যক্ষ হলেন। স্কুলটির বয়স মাত্র দেড় বছর হয়েছে, এবার তিনটি পরিবেশনা থাকবে সেখানকার শিক্ষার্থীদের। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে। স্কুলটি নিয়ে আমরা আশাবাদী।

প্রথম আলো: পরিবার থেকে কি শুদ্ধ সংগীতে উৎসাহ দেওয়া হয়?

আবুল খায়ের: মা-বাবা শুদ্ধ সংগীত শিখতে উৎসাহ দেন না এ থেকে রোজগার নেই বলে। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, সব কটি চ্যানেলকে বাধ্যতামূলক এক ঘণ্টা উচ্চাঙ্গসংগীত চালানোর রীতি চালু করা হোক। সিএসআর ফান্ড থেকে ১০ বা ১৫ হাজার টাকা সম্মানী দিক চ্যানেলগুলো। তাহলে তারা একটি প্ল্যাটফর্ম পাবে। একসময় এটাকে পেশা হিসেবে নিতে পারবে।

প্রথম আলো: গত এক বছরে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে। এবারের আয়োজনে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ছিল?

আবুল খায়ের: জঙ্গিদের ভয়ে তো আমরা বসে থাকতে পারি না। সংস্কৃতি দিয়ে তাদের জয় করা যায়। অপরাধী অল্প কজন। আমরা শুদ্ধ সংস্কৃতি দিয়ে কেন তাদের জয় করতে পারব না? আড়াই হাজার সিনেমা হল যদি সারা দেশে হতো, ৩০ হাজার খেলার মাঠ থাকত, তাহলে দেশে জঙ্গিবাদ থাকত না। শঙ্কা থাকার পরও তাই উৎসবের আয়োজন করলাম। বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশি আগ্রহী ছিলেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে ব্যবস্থা করেছেন। বিশেষ করে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ খুবই সহযোগিতা করেছে।

প্রথম আলো: এত কিছু একসঙ্গে কীভাবে সামলাচ্ছেন?

আবুল খায়ের: আমি পাগল মানুষ। শিল্পকলার প্রায় সব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। জোর করে রাজনীতিতে আনতে চাইলেও যাব না। আমার একটা বদনামও আছে। সবাই বলেন, আমি চিন্তায় অগ্রসর, ব্যবসাটা ভালো বুঝি। কিন্তু আমি শেষ করতে পারি না। একটা কাজ চলাকালে আরও একটি কাজ শুরু করে দিই। আর্ট ও কালচার নিয়ে কাজ শেষ করতে পারি, কারণ এটা আমার প্যাশন। রাত তিনটা পর্যন্ত অফিস করলেও ক্লান্ত হই না। তা ছাড়া আমার সঙ্গে একদল লোক অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বিশেষত, লুভা নাহিদ চৌধুরীর কথা বলতে হয়, তিনি না থাকলে এত কিছু সামলাতে পারতাম না। আর একটা কথা, সদ্যপ্রয়াত খ্যাতিমান সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক শুরু থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এবারের উৎসবটি তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

প্রথম আলো: শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?

আবুল খায়ের: এই উৎসবের শ্রোতারা প্রতিবারই খুব ভালো আচরণ করেন। একটা কথাই বলব, নিরাপত্তার কারণে পার্কিং না থাকায় এবার একটু কষ্ট করতে হবে তাঁদের। এটা যেন সবাই মেনে নেন। সে জন্য আমি তাঁদের কাছে করজোড়ে আবেদন করব, কষ্ট করে হলেও মেনে নিন। এর নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই।