Menu

আত্মানুসন্ধানীর মনে সঙ্গীতই বাঁধে বাসা

thumbnail

গান কখনও শেখা যায় না। এটা ধারণ করতে হয়। প্রত্যেকের মধ্যেই সঙ্গীত রয়েছে। নিজেকে সন্ধান করে, অনুভব করে তা জেনে নিতে হয়। গান আসে দেহের ভেতর লুকিয়ে থাকা আত্মা থেকে। আত্মানুসন্ধান করাই বড় কথা। আত্মানুসন্ধানীর মনে সঙ্গীতই বাসা বাঁধে। সঙ্গীতের ওপর তাকে বাসা বাঁধতে হয় না। সমকালের সঙ্গে সাক্ষাতে এসব কথা বললেন উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি খেয়াল শিল্পী পণ্ডিত যশরাজ। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়ালে যে ক’জন হাতেগোনা জীবন্ত দিকপাল রয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

পণ্ডিত যশরাজ বলেন, ‘ওপরওয়ালা আমাদের একটি শরীর দিয়েছেন। সেই শরীরে তার মাথা আছে। মন আছে। এর মধ্যেই রয়েছে রস-সুর-তালসহ সকল রহস্য। সবকিছুর ব্যবস্থা তিনিই করে রেখেছেন। তবে আত্মানুসন্ধান করে খুঁজে নিতে হবে। মার্গ সঙ্গীত এমন এক জিনিস, চাইলেই পাওয়া যায় না। রাগ সৃষ্টি করা যায় না। মন থেকে যেটা বের হয় সেটাই প্রকৃত সঙ্গীত।’

কয়েক দশক ধরেই পণ্ডিত যশরাজ তার কণ্ঠের জাদু ও সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের দর্শক ও ভক্তদের। কয়েক বছর আগে তিনি কণ্ঠের জাদু দেখিয়েছেন এ দেশে এসে। সেই পণ্ডিতের কণ্ঠে আরেকবার ঐশ্বরিক খেয়াল শোনার সুযোগ করে দিয়েছে এবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। রাজধানীর ধানমণ্ডির শেখ কামাল আবাহনী মাঠে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত পঞ্চ-রজনী উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ রজনীতে আজ শুক্রবার মধ্যরাতে খেয়াল পরিবেশন করবেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যশস্বী এই শিল্পী। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পণ্ডিত যশরাজ বলেন নানা কথা। টুকরো টুকরো কথায় তুলে ধরেন, কীভাবে সাঙ্গীতিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তিনি। কীভাবে সঙ্গীতের মধ্যে বাঁচতে শিখেছেন। কীভাবে সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ওপরওয়ালাকে উপলব্ধি করেছেন।

তিন বছর বয়সে পণ্ডিত মোতিরামের কাছে সঙ্গীতের হাতেখড়ি তার। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের অন্যপ্রান্তে যারা বাবা ও ছেলে। কিন্তু হঠাৎই বাবা মারা গেলেন। যশরাশের বয়স তখন চার। শুরু করলেন বড় দাদার কাছে সঙ্গীত শেখা। বংশের চতুর্থ প্রজন্ম পণ্ডিত যশরাজকে গান শেখার কথা আলাদাভাবে ভাবতে হয়নি কখনও। মেওয়াতি ঘরানার সুর-তাল-ছন্দ-স্বর সবই আত্মস্থ করে ফেলেন তিনি। পরে সান্নিধ্যে আসেন আধ্যাত্মিক গুরু মহারাজা জয়বন্ত সিংহের।

সার্থক শিল্পী হতে গেলে কী করতে হবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে পণ্ডিত যশরাজ বলেন, প্রথমে ওপরওয়ালার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাবা-মার কথা ভক্তি করে স্মরণ করতে হবে। তৃতীয়ত, গুরুজির কথা ভক্তি করে মানতে হবে। যেভাবে গুরু বলেন, মন থেকে মেনে নিতে হবে। তবেই সাফল্যের মুখ দেখা সম্ভব। তিনি বলেন, লড়াইয়ের মধ্যেও সাফল্য পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সফল ব্যক্তিদের ‘আমি’র ওপর নজর দেওয়া উচিত হবে না। মানুষ যখন নিজেকে নিয়ে অহঙ্কারী হয়ে ওঠে তখন সে শেষ হয়ে যায়। তার লড়াইও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। নিজেকে কখনও বড় মনে করি না। এখনও অনেক কিছু শেখার আছে, জানার আছে। গুরুজিকে এখনও স্মরণ করে চলি।’

পণ্ডিত যশরাজের বয়স এখন ৮৮ বছর। এই বয়সেও তিনি তার কণ্ঠের দ্যুতি ছড়াচ্ছেন বিশ্বময়। খেয়াল পরিবেশনার ক্ষেত্রে তরুণ বয়সের আর বেশি বয়সের কণ্ঠের মধ্যে তেমন তারতম্য হয় কি-না, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বয়সের কারণে একটা ছাপ পড়ে বটে; তবে রেওয়াজের মধ্যে থাকলে বয়স ও কণ্ঠকে অনেক শাসনে রাখা যায়। রেওয়াজ বয়স ও কণ্ঠের মধ্যে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করে। এই সেতুবন্ধই কিছুটা হলেও বয়স ও কণ্ঠকে বুড়িয়ে যেতে রক্ষা করে। রেওয়াজের কোনো বিকল্প নেই। এই বয়সেও নিয়মিত রেওয়াজ করি।

মার্গ সঙ্গীতে যারা সাফল্য পেয়েছেন তারা কমবেশি ওপরওয়ালায় বিশ্বাসী। তবে পণ্ডিত যশরাজ এ-ও মনে করেন, রেওয়াজ-পরম্পরা-সাধনা- এই তিনটি বিষয়ও ভালো শিল্পী হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। তার ক্ষেত্রে এসবের অনেকটাই প্রযোজ্য। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনই সঙ্গীত, যা কিছু করতে চাই, সঙ্গীত দিয়ে করতে চাই।’

ভারতের প্রধান প্রধান ঘরানা কোনগুলো এবং মেওয়াতি ঘরানার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?- জানতে চাইলে আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ইঙ্গিত করে যশরাজ বলেন, ‘আমরা সর্বদা স্রষ্টার জন্য গাই। প্রত্যেকেই। স্রষ্টা মানে কৃষ্ণ, রাম, আল্লাহ, গড, ঈশ্বর সব। এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুরকে খুব ভালোবাসি- মনে করি, যে কেউ মেওয়াতি মানে সে সুরকে ভালোবাসে।’

যশরাজের ভক্তকুল ভারতের সীমানা ডিঙিয়ে ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশেও কম নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এর আগে একবার এসেছিলাম। তখনও শ্রোতাদের আগ্রহ দেখেছি ব্যাপক। এবার বেঙ্গলের আমন্ত্রণে এলাম। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, মার্গ সঙ্গীত শোনার কান আরও তৈরি হয়েছে। শিল্পীও তৈরি হয়েছে। এটা আয়োজকদের একটা বিরাট সাফল্য।

পণ্ডিত যশরাজ বলেন, শান্তিতে না থাকলে ‘সুর’ সৃষ্টি হয় না। শান্তিই সুর সৃষ্টির অন্যতম রসদ। সবাই এখন শান্তিতে আছি। তা না হলে বছর বছর উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের আয়োজন কেন হবে? শান্তির বারতা দেয় এই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। যশরাজ জানান, আগের দিনের গান হিমালয়ের মতো আর এখনকার গান সমুদ্রের মতো। তবে তিনি মনে করেন, গান এখনও হিমালয়ের মতো রয়েছে। তিনি বলেন, গানের কোনো সোনালি যুগ হয় না, প্রতিটি সকালই হচ্ছে সোনালি যুগ। আগামী ১০০ বছর পর আমি তো বলতে পারব না, কোনটা সোনালি যুগ। আগাম করে বলা সম্ভবও নয়। এখন এ মুহূর্তে যে সময় উপভোগ করছি সেটাই স্বর্ণালি যুগ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আতিথেয়তায় তিনি মুগ্ধ। বাংলাদেশি খাবারের মধ্যে আলুভর্তা হচ্ছে তার প্রিয় খাবার।

পণ্ডিত যশরাজ ২০০০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মবিভূষণ’ অর্জন করেন। পদ্মভূষণ পান ১৯৯০ সালে। আর পদ্মশ্রী লাভ করেন ১৯৭৫ সালে।

 

View Full Article