উচ্চাঙ্গের নাচগানের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতের মাধুর্য্যে স্পন্দিত হৃদয়তন্ত্রী
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব
মনোয়ার হোসেন ॥ বিশাল প্রান্তরে ভিড় জমাচ্ছেন হাজার হাজার সুররসিক। গত চারদিন ধরে সুন্দরের এই দৃশ্যকল্প রচিত হয়েছে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরসুধায় অনাবিল আনন্দে কেটে যাচ্ছে সন্ধ্যা থেকে ভোর। কংক্রিটের শহরে নগরবাসীর একঘেয়ে জীবনের মাঝে সঞ্চারিত হয়েছে প্রাণপ্রবাহ। উচ্চাঙ্গের নাচ-গান ও যন্ত্রসঙ্গীতের মাধুর্যে স্পন্দিত হয়েছে মন। আর এভাবেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব শহরে ছড়িয়েছে সুন্দরের বারতা।
রবিবার ছিল পঞ্চরজনীর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ রজনী। এ রাতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাসরের সূচনা হয় কত্থক নাচের নান্দনিকতায়। এ রাতে বেজেছে শ্রবণ ইন্দ্রিয় আলোড়িত করা তবলার বোল, খেয়ালের সুরের শ্রোতা হয়েছে তন্ময়, কর্ণাটক কণ্ঠসঙ্গীতে উচাটন হয়েছে হৃদয়তন্ত্রী, সরোদের সুরেলা শব্দধ্বনির মুগ্ধতা শেষে পুনরায় অজয় চক্রবর্তীর খেয়ালের মোহময়মতায় শেষ হয়েছে পরিবেশনা। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গ করা পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত এ উৎসবের আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। স্কয়ার নিবেদিত এ সঙ্গীত আসরের সহযোগিতায় রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক।
হিমেল সন্ধ্যায় কত্থক নাচকে সঙ্গী করে শুরু হয় পরিবেশনা পর্ব। নূপুরের শব্দ তুলে মঞ্চে আসে মুনমুন আহমেদ ও তাঁর দল রেওয়াজ। মুদ্রা ও অভিব্যক্তির অনবদ্য সম্মিলনে লাল-নীল পোশাকের নৃত্যশিল্পীরা কুড়িয়ে নেন দর্শকদের প্রশংসা। গুরু বন্দনার মাধ্যমে রাগ ভিন্ন ষড়জে শুরু হয় এ দলের পরিবেশনা। এরপর ছিল ত্রিতালে কত্থক, যার প্রথমাংশে বিলম্বিত লয়ে ঠাট, উঠান, আমাদ ও পরন-আমাদ। পরবর্তীতে মধ্য লয়ে তেজামদ, টুকরা, তেহাই, পরন, পারমিলু ও লাড়ি। দ্বিতীয় অংশে রাগ গৌড় মল্্হারে বিন্দাদিন মহারাজ রচিত ঠুমরি ‘মোরি গগরিয়া কাহেকো ফোড়ি রে শ্যাম’ এর সঙ্গে মুনমুন আহমেদ একক কত্থক নৃত্য পরিবেশন করেন। শেষ অংশে দ্রুত লয়ে দুটি পরন এবং যুগলবন্দী। এ দলে অংশ নেয়া অন্য নৃত্যশিল্পীরা হলেন ঐশ্বরিয়া রহমান, আনিসা আইরিন আহমেদ, অবন্তিকা আলরেজা, লাভা বিশ্বাস, মহিমা আনাম, মাইশিা মালিহা খান, নুসরাত ফাতিমা, পারমিতা রহমান, শর্মিষ্ঠা সোনালিকা প্রমুখ। পুরো পরিবেশনায় কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন তানজিলা করিম স্বরলিপি। তবলায় সুবীর ঠাকুর, সরোদে সুনন্দ মুখার্জি, বাঁশিতে মনিরুজ্জামান।
মুনমুন আহমেদ ও তার দলের পরিবেশনা শেষে তবলা নিয়ে মঞ্চে আসেন ভারতের নীলেশ রণদেব। তিনি তবলায় বাজিয়ে শোনান তিন তাল। হারমোনিয়াম সহযোগিতায় ছিলেন মিলিন্দ কুলকার্নি। প-িত সুরেশ তালওয়ালকারের শিষ্য এ শিল্পী বিশ্বের বিভিন্ন বড় সঙ্গীত উৎসবে অংশ নিয়েছেন।
খেয়াল পরিবেশন করেন কিরানা ঘরনার কণ্ঠশিল্পী জয়তীর্থ মেউন্ডি। প্রথমেই পরিবেশন করেন রাগ শুদ্ধ কল্যাণ। এরপর তাঁর কণ্ঠে শোনা যায় রাগ আদানা। নাট্যগীত পরিবেশনের মাধ্যমে পরিবেশনার সমাপ্তি টানেন। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ‘ইয়াং মায়েস্ত্রো ইন মিউজিক’ পুরস্কারপ্রাপ্ত এ শিল্পীর পরিবেশনা খেয়ালে ভিন্নতার আমেজ এনে দেয়।
এরপর ছিল প-িত যোগেশ শামসি ও প-িত শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের তবলার যুগলবন্দী। তবলার বোলে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দেয়া এই যুগলের পরিবেশনা সুখ যুগিয়েছে শ্রোতার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে। তাঁদের ত্রিতালের বাদনটি ছিল অনবদ্য। সেই সুবাদে কয়েক দফায় কুড়িয়ে নেন শ্রোতাদের করতালি।
চতুর্থ রাতের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কর্ণাটকি কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী দুই বোন রঞ্জনি বালসুব্রহ্মণ্যন ও গায়ত্রী বালসুব্রহ্মণ্যনের যুগল পরিবেশনা। শিল্পীদ্বয়ের স্বতন্ত্র্য গায়কী ছুঁয়ে যায় সঙ্গীতপ্রেমীদের মন।
সরোদ নিয়ে মঞ্চে আসেন প-িত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। স্বনামধন্য সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের কৌশলগত দক্ষতা এবং ধ্রুপদ, তন্ত্রকারী ও বিভিন্ন গায়কীর উপাদানে সমুজ্জ্বল ছিল পরিবেশনাটি। চতুর্থ রজনীর শেষ পরিবেশনা ছিল এই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আসরের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী প-িত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল। ভোরের সূচনালগ্নটি আপন করে নেন কণ্ঠের মাধুর্যে। অপেক্ষায় থাকা শ্রোতাদের ভাসিয়ে দেন নির্মল আনন্দে। গুণী এই শিল্পীর পুরস্কার ও অর্জনের তালিকা দীর্ঘ। পদ্মশ্রী, আইটিসি-এসআরএ স্বর্ণপদক, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, বঙ্গ বিভূষণসহ পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতি।
আজকের সমাপনী পরিবেশনা : উৎসবে সমাপনী ও পঞ্চম দিন সোমবার দলীয় কন্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগের শিল্পীরা। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনাবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। আবারও সন্তুরের মোহনীয় সুরে ভাসাবেন প-িত শিব কুমার শর্মা। কুমার মারদুর শোনাবেন খেয়াল। সেতার পরিবেশন করবেন প-িত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশন করবেন আরতী অঙ্কালিকার। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে সুরে শেষ হবে এই উৎসব।
সমাপনী আনুষ্ঠানিকতায় প্রধান অতিথি থাকবেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপার্সন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত থাকবেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। সভাপতিত্ব করবেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।