কটিয়াদীতে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী মন চায় বারবার এই ভিটায় আসি
সৈয়দ সিরাজুল সালেহীন রাহাত, কটিয়াদী থেকে
পাঁচ দিনের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব শেষ হতে না হতেই অব্যক্ত টানে মাতৃ-পিতৃভূমিতে গতকাল বুধবার ছুটে এসেছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন পৈতৃক ভিটা ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার মুশুলী আর মায়ের জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রাম। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শ্রীশ্রী গোপীনাথ জিউর আখড়া ও অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকার
সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়িও দেখতে যান তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন দুই কাকা সুরজিৎ কুমার চক্রবর্তী, দীনেশ কুমার চক্রবর্তী ও পিসিমা মিনতি মুখার্জি। সন্ধ্যার পর তিনি মুখোমুখি হন সমকালের।
সমকাল :শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
অজয় চক্রবর্তী :শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রের উৎসই তো বাংলাদেশ। তবে প্রচার ও প্রসার এ দেশে ঠিকমতো হচ্ছে না। জন্ম এ দেশে হলেও নানা দৈন্য ও সাধনার অভাবে এ দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অথচ ওপার বাংলায় এর চর্চা ব্যাপক। তবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পাঁচ বছর ধরে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। এর জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আবুল খায়ের ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
সমকাল :এ দেশে আপনার পিতামাতার আদি বাড়ি। এখানকার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্নয়নে আপনারও তো ভূমিকা আছে_
অজয় :হ্যাঁ, আমার পিতামাতার আদি বাড়ি এখানে। আমার বাবা ১৯৪৭ সালে খালি হাতে ওপার বাংলায় চলে যান। ছোট থেকেই আমি খুব কষ্ট করে বড় হয়েছি। তবে এ-ও ঠিক, সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম বা সাধনার বিকল্প নেই। আমি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে বলেছি এ দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে। তিনি বলেছেন, দেশের ৬৪টি শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে তা শুরু করবেন। আমার একটি অনলাইন লাইভ পোর্টাল আছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা সঙ্গীত তালিম নিচ্ছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খরচে এখানে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। তবে বাংলাদেশের সঙ্গীত শিক্ষার্থীরা পরিশ্রমী না। অথচ পরিশ্রম ছাড়া কোনো সাধনাই সফল হয় না, শিখরে পেঁৗছায় না।
সমকাল :বাংলাদেশ না ভারত_ নারীর স্বাধীনতা কোন দেশে বেশি?
অজয় :আমরা নারী স্বাধীনতার জন্য হৈচৈ করলেও বাস্তবে তা নেই। তবে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে একটু এগিয়েই রয়েছে। নারীর মতামতকে তেমন প্রাধান্য দেওয়া হয় না। সে কারণেই সঙ্গীতসহ নানা ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছে। আমার মা না হলে আমার এ চাঁদমুখটা কোত্থেকে আসত? তাই আজ থেকেই সবাইকে নারীর কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে।
সমকাল :বাংলাদেশে ব্র্যাক ও সমকাল যৌথ উদ্যোগে মায়া আপা নামে একটি অ্যাপস চালু করেছে। এতে নারীর যাবতীয় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অজয় :শুধু কাগজে ব্যবস্থা থাকলে তো হবে না। তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কেউ তা করছে না। দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, তার পরও সামগ্রিকভাবে নারীর উন্নতি কিন্তু কম।
সমকাল :আপনি এবার কাকা, পিসিকে নিয়ে এসেছেন। তাদের পৈতৃক ভিটা বৃহত্তর ময়মনসিংহে ঘুরে বেড়ালেন। তাদের অনুভূতি কী?
অজয় :আমার দুই কাকা সুরজিৎ কুমার চক্রবর্তী (৮৭) ও দীনেশ কুমার চক্রবর্তী (৮৩) এবং পিসিমা মিনতি মুখার্জিকে (৭৮) অনেকটা জোর করেই নিয়ে এসেছি। তারা তাদের পৈতৃক বাড়ি ও বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখে খুবই অভিভূত হয়েছেন। আমার মা ও বাবাকেও এর আগে নিয়ে এসেছিলাম। তারা খুবই উৎফুল্ল এ দেশের মানুষের আতিথেয়তা দেখে, যা ওপার বাংলায় কম। আমার মামাদের আদর-আপ্যায়নেও আমি মুগ্ধ। শত হলেও মায়ের জন্মভিটা। আমার মন বারবার এই ভিটায় আসতে চায়। ঢাকায় এলেই আমি এ মাটিতে ছুটে আসি।
সমকাল :বাংলাদেশ ও ওপার বাংলার লেখাপড়ার মান নিয়ে কিছু বলবেন?
অজয় :বাংলাদেশকে শিক্ষায় এগোতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষা তো শুধুই সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য নয়। নিজেকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। তবেই প্রকৃত মানুষ হওয়া যাবে।
সমকাল :সত্যজিৎ রায় ও সুকুমার রায়ের পৈতৃক ভিটায় গিয়ে আপনার কেমন লেগেছে?
অজয় :আমরা এসেছি শুনে কটিয়াদী সুকুমার রায় আবৃত্তি পরিষদ আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করেছে। তাদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। ওই বাড়িটিকে সংস্কার করে একটি লাইব্রেরি বা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার।
সমকাল :আমাদের সময় দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।
অজয় :সমকালের মাধ্যমে এ দেশের মানুষকেও অভিনন্দন জানাই।