চৌরাসিয়ার বাঁশিতে ফুরালো রজনী
একটি দুটি করে চলে এলো পঞ্চম ও শেষ রজনী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরে অবগাহন করার মধ্য দিয়েই কেটে গেল কতগুলো প্রহর। তবু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের শেষ রাতটি মনে থাকবে সবার।
শেষ রাতের শেষটা যে হয়েছে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির জাদুতে মোহনীয়তা ছড়িয়ে। সে বাঁশির সুরে আন্দোলিত হয়েছে তনুমন। পঞ্চম রাতের শুরুতেই ছিল ওড়িশি নৃত্যের পরিবেশনা।
এরপর মোহন বীণা, খেয়াল, সেতারের যুগলবন্দি, একক সেতার বাদনের শেষে মাঝরাত পেরিয়ে সবার শেষে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া।
তার বাঁশির সুরের মোহময়তায় রাজধানীর আবাহনী মাঠে নেমে এসেছিল স্বর্গীয় আবেশ। মাঠভর্তি হাজার হাজার মানুষের প্রতীক্ষার প্রহর যেন ফুরালো শেষ রাতে তার আগমনে।
পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া আরও কয়েকবার এ উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। কিন্তু তার বাঁশির সুরে যে আর মন ভরে না। বারবার শুনতে চায় মন।
সেই সুরের মোহময়তাকে সঙ্গী করেই ভাঙল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের ষষ্ঠ আসর। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক।
এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে শিক্ষাবিদ ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে। শেষ দিনের আয়োজন শুরু হয় ওড়িশি নৃত্য দিয়ে, যা পরিবেশন করেন বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র।
প্রথমেই তিনি পরিবেশন করেন ‘অর্ধনারীশ্বর’। অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ শরীর বহনকারী প্রভু অর্ধনারীশ্বরের প্রণতি করে তিনি তার পরিবেশনা শুরু করেন।
রাগ মল্লিকা ও তাল মল্লিকার এ পরিবেশনার নৃত্য রচনা ও পরিচালনা করেছেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র এবং সঙ্গীতে ছিলেন পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্র।
এরপর তার পরিবেশনা ছিল ‘রামায়ন-লঙ’। নৃত্যের এ অংশটি ভক্তকবি জগন্নাথ দাস রচিত ওড়িশি রামায়ন থেকে নেয়া। এটি মূলত একটি বড় নৃত্যনাট্যের অংশবিশেষ।
পরিবেশনাটি পরিচালনা করেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ও সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন পণ্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্র।
এরপর মোহন বীণা-বাদন করেন পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। বিশ তারের হাওয়াইন গিটার সাদৃশ্য এ যন্ত্রে তিনি সুর তোলেন। এরপর কণ্ঠে সুরের চার পাশ ছড়িয়ে দিয়ে খেয়াল পরিবেশন করেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। বিঞ্চুপুর ঘরানার এ শিল্পীর পরিবেশনা শেষে মঞ্চে যৌথ সেতার-বাদনে অংশ নেন উত্তর ভারতের শিল্পী পণ্ডিত কুশল দাস এবং সেনিয়া মাইহার ঘরানার শিল্পী কল্যাণজিত দাস।
পণ্ডিত কৈবল্যকুমার এরপর সেতার-বাদন করেন। কিরানা ঘরানার তৃতীয় প্রজন্মের এ শিল্পী তার সম্ভাবসুলভ তাল পরিবেশন করেন। দিনের এবং এবারের উৎসবের সব শেষে ছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিবাদন। যার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবের এবারের আয়োজন।
শুক্রবার মধ্য রাতের আয়োজন : শুক্রবার মধ্য রাতে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খানের খেয়াল শেষে ছিল সরোদ এবং বেহালার যুগলবন্দি।
পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ একসঙ্গে পরিবেশন করেন রাগ সিমেন্দ্রমধ্যমম। তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার।
এরপর খেয়াল পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত যশরাজ। তিনি প্রথমে রাগ যোগ খেয়াল পরিবেশন করেন এবং পরে দুর্গা রাগে ভজন পরিবেশন করেন।
তাকে তবলায় সঙ্গত করেন রামকুমার মিশ্র, হারমোনিয়ামে পণ্ডিত তৃপ্তি মুখার্জি, কণ্ঠে রত্তন মোহন শর্মা এবং মৃদঙ্গমে শ্রীধার পার্থসারথী।
খেয়াল শেষে প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবে চেলো’র পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। তিনি রাগ নন্দকোষ পরিবেশন করেন।
এরপর তিনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’- এ দু’টি রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডু ও টিংকু কুমার শীল।
উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির সেতার। তিনি রাগ ললিত বিস্তার গৎ ঝালা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সৌমেন নন্দী।