চৌরাসিয়ার বাঁশি আলো ছড়ালো মনে
ভোর হতে কে না দেখেছে! কিন্তু চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে সেই ভোরের আলো মনেও আলো ছড়াল। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক ভাসলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার অপার্থিব বাঁশির সুরের মূর্চ্ছণায়। বাঁশুরিয়া হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া তার মোহন সুর রাতের অবসান আর ভোরের আলো ফোটার মূহূর্তে যেন অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করলেন। উত্সবের সমাপ্তি ঘটলো তাঁর অপার্থিব সুরের দোলায়।
এদিকে, সঙ্গীতরসিকদের আগ্রহ বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসার ঘটাবে, সংস্কৃতির শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে এ প্রত্যাশা নিযে শেষ হলো পাঁচ দিনের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উত্সব। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার মাধ্যমে এ অঞ্চলের হূত গৌরব ফিরিয়ে আনবে এমনটাই স্বপ্ন ব্যক্ত করলেন আয়োজকরা। পাঁচ দিন আগে যে উত্সব শুরু হয়েছিল তা উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। গতকাল শনিবার শেষ হলো সেই সুরের মেলা। গতকালও ভোর পাঁচটা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে একের পর এক ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুর মুর্ছনায় আপ্লুত হয়েছে হাজারো দর্শক-শ্রোতা।
সমাপনী দিনের আলোচনায় অংশ নেন ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ছায়ানটের সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুন, প্রফেসর এমিরেটাস আনিসুজ্জামান, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু। এছাড়াও আবাহনী ক্লাবের পরিচালক ও সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ অনুষ্ঠানে উপিস্থত থাকতে না পারায় তার মা সঙ্গীতশিল্পী আমিনা আহমেদ সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেন, সুরের জগতে তারকা শিল্পীদের পরিবেশনা অমাদের অনাবিল আনন্দে মন ভরিয়ে দিয়েছে।
সন্জীদা খাতুন বলেন, আমার যেখান থেকে বাধা পাই, যেখান থেকে আমাদের ওপরে বোমা নিক্ষেপ করা হয়, সেখানে সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে প্রতিহত করতে চাই। সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতির শক্তি উপলব্ধি করেছিলেন তার সেই উপলব্ধিকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। শুধু পৃষ্ঠপোষকতা নয় সহযোগী হতে হবে। সর্বস্তরের মানুষকে সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করতে হবে। ধ্বংস নয়, মানুষকে ভালোবাসাই যে সবচেয়ে বড় কথা- এই বার্তা নিয়ে আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হবে।
আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ধারাটি যখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে তখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সম্মেলন সেই ধারার পুনর্জীবন দান করেছে। এই বছর উত্সবে উপমহাদেশের বাইরেও কাজাখস্তানের অর্কেস্ট্রা দল এসেছে। তার মানে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উত্সব নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
নাবিল আহমেদ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, আবাহনী ক্লাব এ ধরনের আয়োজনের জন্য সবসময় মাঠ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। আশা করি, আগামী বছরও এই মাঠেই উত্সব আয়োজিত হবে।
বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র মঞ্চ আলোকিত করেন ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। পরিবেশনাটি অর্ধনারীশ্বর ও রামায়ণ-লঙ- এ দুই পর্বে বিভক্ত ছিল। রাগমল্লিকা ও তালমল্লিকাভিত্তিক প্রথম পর্ব অর্ধনারীশ্বরের কোরিওগ্রাফি ও নৃত্য রচনায় ছিলেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র; সংগীত পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পন্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্র।
ওড়িশি রামায়ণ থেকে নেওয়া দ্বিতীয় পর্ব রামায়ণ-লঙ-এর কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র; সংগীতপন্ডিত ভূবনেশ্বরমিশ্র। নৃত্যনাট্যটিতে সুজাতা মহাপাত্রের সহশিল্পী ছিলেন সৌম্য বোস। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উত্সবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
পঞ্চম দিনে মঞ্চে সুরলহরী তোলে পন্ডিত বিশ্বমোহন ভট্টের মোহন বীণা, ব্রজেশ্বর মুখার্জির খেয়াল, পন্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণজিত দাসের সেতার, পন্ডিত কৈবল্যকুমারের খেয়াল। উত্সবের সমাপ্তি হয় পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে।
গত পাঁচ বছর ধরে আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব শিল্পী ও দর্শকের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশ তথা বিশ্বের সর্বাধিক বড় পরিসরের উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বছর উত্সব উত্সর্গ করা হয়েছে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে।
গত চারদিনে আরো যারা আসর মাতিয়েছেন তারা হলেন ড. এল সুব্রহ্মন্যণ, বিদূষী পদ্মা তালওয়ালকর, প্লিত শিবকুমার শর্মা, পন্ডিত উলহাস কশলকর, ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খাঁ, পন্ডিত রণু মজুমদার ও পন্ডিত দেবজ্যোতি বোস, বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়করাম, পন্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, কলা রামনাথ, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পন্ডিত যশরাজ, ওস্তাদ রশিদ খান, সাসকিয়া রাও দ্যওহাস, পন্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির মতো গুণী শিল্পীরা।