Menu

চৌরাসিয়ার বাঁশি শীবকুমার শর্মার সম্তরে স্বর্গীয় অনুভূতি

thumbnail

গভীর শীতের রাতে ঘুমে তলিয়েআছে রাজধানী ঢাকা। কিন্তু নিশিজাগা পাখির মত জেগে আর্মি স্টেডিয়াম। ভোর হতে কে না দেখেছে কিন্তু চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনে সুরে মনে হলো প্রকৃতিতে সুরের ছোঁয়া দিয়ে আলো জ্বেলে দিলেন তিনি। শ্রোতা-দর্শক ভাসলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার অপার্থিব বাঁশির সুরের মূর্চ্ছণায়। বাঁশি হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতীক। যার সুর ঐশ্বরিক ভালোবাসার আহ্বান জানায়। বাঁশুরিয়া হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া তার মোহন সুরে রাতের অবসান আর ভোরের আলো ফোটার মূহূর্তে যেন অপার্থিব দ্যোতনার সৃষ্টি করলেন। উত্সবের সমাপ্তি ঘটলো তাঁর ঐশ্বরিক সুরের দোলায়।

চৌরাসিয়া যদি দেন ঐশ্বিরিক সুরের ছোঁয়া তাহলে শিবকুমার শর্মার সন্তুর সুরে সুরে ছড়িয়ে দিল পবিত্রতার অনুভব। শুদ্ধতম সঙ্গীতের শুদ্ধতম অনুভবই হাজার হাজার বছর ধরে লালিত সুরের মূল ধারা। যা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে। শিবকুমার শর্মার সন্তুরের সুরের অনুরণন সেই অনুভূতিই ছড়ায় অস্তিত্বের গভীরে। তার সন্তুরের মৃদু ঝঙ্কার মনকে শান্ত করে, নিঃসীম এই প্রকৃতির মাঝে লীন হয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। গতকাল শিবকুমার শর্মার প্রায় দেড় ঘণ্টার সুরভ্রমণ পিনপতন নিস্তব্ধতায় উপভোগ করলেন হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক।

রক্ষণশীলদের নানা বাধার মধ্যেই তিনিই কাশ্মীরী লোক সংগীতে ব্যবহূত সন্তুরকে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মঞ্চে নিয়ে এসেছেন। তার একনিষ্ঠ অধ্যবসায়, অনবরত নিরীক্ষা এবং সন্তুরকে নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা এক নতুন সঙ্গীত ধারার সূচনা করেছে। পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ সম্মাননায় ভূষিত এই শিল্পীর পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মেতো উপভোগ করেছেন দর্শক শ্রোতারা। প্রায় চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় ব্যবহূত এক ধরনের তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র থেকে আজকের সন্তুরের উত্পত্তি। দীর্ঘদিন ধরে সন্তুর ভারতবর্ষে- বিশেষ করে জম্মু ও কাশ্মিরে শুধুমাত্র লোকবাদ্যযন্ত্র হিসেবেই পরিচিত ছিল। তবে মূলত এটি পার্শিয়া থেকে এসেছে। উনিশ শ পঞ্চাশের দশক থেকে ভারতের প্রতিভাধর সঙ্গীতজ্ঞ-পন্ডিত শিবকুমার শর্মা সন্তুরের সেই সীমাবদ্ধ গণ্ডিটি ছাড়িয়ে সুরেলা ঐ তারের বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে গিয়েছেন লোকোত্তর এক উচ্চতায়- সন্তুরকে দান করেছেন এক গভীরতম স্বর্গীয় মহিমা-সেই সঙ্গে পেয়েছেন বিশ্বের সংগীতপিপাসু মানুষের অকৃত্রিম অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

এদিকে, সঙ্গীতরসিকদের আগ্রহ বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসার ঘটাবে, সংস্কৃতির শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে এ প্রত্যাশা নিয়ে শেষ হলো পাঁচ দিনের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উত্সব। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার মাধ্যমে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবদের সৃষ্টি করা এ অঞ্চলের হূত গৌরব ফিরিয়ে আনবে এমন স্বপ্ন ব্যক্ত করলেন আয়োজকরা। পাঁচ দিন আগে যে উত্সব শুরু হয়েছিল তা উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। আজ মঙ্গলবার ভোরে শেষ হলো সেই সুরের মেলা।

উত্সবে সমাপনী ও পঞ্চমদিন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি ও পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার সন্তুরের পরিবেশনা ছাড়াও দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগের শিল্পীরা। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। কুমার মারদুর শোনান খেয়াল। সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশন করেন আরতী অঙ্কালিকার।

সমাপনী দিনের পরিবেশনার শুরুতেই কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগের শিল্পীরা। তারা রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন মো. জাকির হোসেন ও স্বরূপ হোসেন।

দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। তারা পরিবেশন করেন চারুকেশী। নিশিত দে, সাম্মো দে, আশিশ নারায়ন সরকার, প্রসেনজিত্ মন্ডল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টিএম সেলিম রেজা, খন্দকার নজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যাতি ব্যার্নাজী, জাহাঙ্গির আলম শ্রাবন, মো. কাওছার প্রমুখের বাদনশৈলী মাতিয়ে রাখে দর্শক শ্রোতাদের। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে দেশের শিল্পীরাও যে এগিয়ে যাচ্ছেন তার সাক্ষর রাখেন শিল্পীরা।

দেশের শিল্পীদের এই দুই পরিবেশনার পরেই ছিল উত্সবের সমাপনী আয়োজন। তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।

সমপানী আয়োজনের শেষে মঞ্চে আসেন এবারের উত্সবের অন্যতম আকর্ষণ পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা। সন্তুরের অপূর্ব পরিবেশেনা শেষে খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন কুমার মারদুর। কুমার মাদুর ধারাওয়াড় গায়নরীতির একজন কুশলী কণ্ঠশিল্পী। কুমারের হাতেখড়ি তার পিতা কিরানা ও গোয়ালিয়র ঘরানার বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত সোমনাথ মাদুরের কাছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন।

সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। তিনি ভারতের একজন বিশিষ্ট সেতার ও সুরবাহার শিল্পী। রাগ দারিতে গভীর প্রজ্ঞার জন্য চন্ডীগড়ের প্রাচীনকলা কেন্দ্র থেকে সংগীতবিশারদ স্বর্ণপদক এবং মুম্বাইয়ের সুরসংগীত সংসদ থেকে সুরমণি খেতাব অর্জন করেছেন। সেতারের তারে তারে তিনি সুরের ধারা বইয়ে দেন।

এবারের উচ্চঙ্গ সঙ্গীত উত্সবের বিশেষ দিক হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই খেয়াল পরিবেশনা ছিল। সমাপনী দিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পণ্ডিত কুশল দাসের পর খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতি অঙ্কালিকার। বিশিষ্ট এই কণ্ঠশিল্পী আগ্রা গোয়ালিয়র ঘরানার পণ্ডিত বসন্ত রাওকুলকার্নি এবং জয়পুর আত্রৌলি ঘরানার কিশোরী আমানকারের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। সুকণ্ঠী এই গায়িকার তাল ও সুরের চমত্কার খেলা এক মোহময় আবহের সৃষ্টি করে। তবলায় তাকে সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে সুরে শেষ হয় এই উত্সব। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উত্সবের এবারের আসর নিবেদন করেছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক।

 

View Full Article