Menu

তেজেন্দ্রর সরোদ ও অজয়ের কণ্ঠসুধায় আবিষ্ঠ চতুর্থদিন চৌরাসিয়ার বাঁশিতে আজ বাজকে বিদায়ের সুর

হাসনাত শাহীন
দারুণ গল্প শুনিয়ে রাত জাগিয়ে রাখা নতুন নয়। আরব্য রজনীর রূপকথায় এর ঢের প্রমাণ মেলে। হাজার বছরের পুরনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই গ্রাম-বাংলায়ও আছে নানান গল্প আর আড্ডায়-আড্ডায় রাত জাগা কাহিনী। নানি-দাদির কাছে ঘুমপাড়ানী পরীর গল্প-ভূতের গল্পসহ নানান রূপকথা আশ্রিত কাহিনী শোনারও কথা এখনও অনেকেই আছে। এছাড়াও বহুকাল থেকে গান পাগল বাঙালির আয়োজনে গ্রামাঞ্চলে পালাগান, যাত্রাগানও হয় রাতভর। তবে শহরে রাত জেগে গান শোনার অবসর কোথায়? শহরবাসীর ব্যস্ততা বড্ড বেশি। এর পরও শুধু সংগীতের টানেই তন্দ্রাহীন রাত কাটাচ্ছে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা। উৎসবের আগের তিন রাত চলে সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি। আলাপ, বিস্তার, তান আর সারগামের এ এক মোহময় আচ্ছন্নতা। সময় যে কিভাবে সুরের ভেলায় ভেসে যাচ্ছিল, ঠিক-ঠিকানা ছিল না তার। নিশিজাগা পাখির মতো গতকাল রোববার রাতেও জেগে ছিল আর্মি স্টেডিয়াম, জেগে ছিল সংগীতপিয়াসী দর্শক-শ্রোতা। জেগে ছিলো বিশ্বখ্যাত সরোদ বাদক তেজন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের সরোদের মন মাতানো সুর-ধ্বনির সাথে হাতের খেলা দেখার অপেক্ষায় আর পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুপম সুর উপভোগের জন্য। বিশ্বের বরেন্য এই শিল্পীদ্বয়ের পরিশেনায় সরোদের মোহনীয় সুর-ধ্বনি আর খেয়ালের অনুপম উপস্থাপনার রেশ যেতে না যেতেই চার দিন আগে রাজধানীর ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যে মহাযজ্ঞের শুরু হয়েছিল আজ শেষ দিনের আয়োজনে পরিবেশনায় অংশ নেবেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বংশীবাদক পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। এবারের আসরের সবার শেষে মঞ্চে আসবেন সারাবিশ্বের অনন্য এই বংশীবাদক। বাঁশিতে বিদায়ের করুণ সুর তুলে এই উৎসবের ইতি টানবেন তিনি।

রাতভর উৎসবের গতকাল চর্তুথ দিন উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা প্রসিদ্ধ নানা ঘরানার নির্মল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতা-দর্শকদের মুগ্ধ করেন। চতুর্থ অধিবেশনে কুয়াশাসিক্ত হেমন্ত সন্ধ্যা থেকে শুরু করে পরদিন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলে শিল্পীদের কণ্ঠে-যন্ত্রে শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরের খেলা আর নৃত্যের ঝংকার।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গকৃত বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এবারের এই আয়োজনের এদিনের এ আয়োজনের শুরুতেই বাংলাদেশের নৃত্যগুরু মুনমুন আহমেদ ও তার দল ‘রেওয়াজ’ কত্থক নাচের নান্দনিকতায় মুগ্ধতা ছড়ান। সেই মুগ্ধতার রেশে তারপরে একে এ রাতের আয়োজনে বেজেছে শ্রবণ ইন্দ্রিয় আলোড়িত করা তবলার বোল, খেয়ালের সুরের শ্রোতা হয়েছে তন্ময়, কর্ণাটক কণ্ঠসঙ্গীতে উচাটন হয়েছে হৃদয়তন্ত্রী, সরোদের সুরেলা শব্দধ্বনির মুগ্ধতা শেষে পুনরায় অজয় চক্রবর্তীর খেয়ালের মোহময়মতায় শেষ হয়েছে পরিবেশনা।

গতকাল হেমন্তের মনোরোম সন্ধ্যায় আয়োজনের শুরুতেই মুনমুন আহমেদ ও তার দলের নূপুরের শব্দ-নাচের মুদ্রা ও অভিব্যক্তির অনবদ্য সম্মিলনে লাল-নীল পোশাকের নৃত্যশিল্পীরা কুড়িয়ে নেন দর্শকদের প্রশংসা। গুরু বন্দনার মাধ্যমে রাগ ভিন্ন ষড়জে শুরু হয় এ দলের পরিবেশনা। এরপর ছিল ত্রিতালে কত্থক, যার প্রথমাংশে বিলম্বিত লয়ে ঠাট, উঠান, আমাদ ও পরন-আমাদ। পরবর্তীতে মধ্য লয়ে তেজামদ, টুকরা, তেহাই, পরন, পারমিলু ও লাড়ি। দ্বিতীয় অংশে রাগ গৌড় মল্্হারে বিন্দাদিন মহারাজ রচিত ঠুমরি ‘মোরি গগরিয়া কাহেকো ফোড়ি রে শ্যাম’ এর সঙ্গে মুনমুন আহমেদ একক কত্থক নৃত্য পরিবেশন করেন। শেষ অংশে দ্রুত লয়ে দুটি পরন এবং যুগলবন্দি। এ দলে অংশ নেওয়া অন্য নৃত্যশিল্পীরা হলেন ঐশ্বরিয়া রহমান, আনিসা আইরিন আহমেদ, অবন্তিকা আলরেজা, লাভা বিশ্বাস, মহিমা আনাম, মাইশিা মালিহা খান, নুসরাত ফাতিমা, পারমিতা রহমান, শর্মিষ্ঠা সোনালিকা প্রমুখ। পুরো পরিবেশনায় কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন তানজিলা করিম স্বরলিপি। তবলায় সুবীর ঠাকুর, সরোদে সুনন্দ মুখার্জি, বাঁশিতে মনিরুজ্জামান।

মুনমুন আহমেদ ও তার দলের পরিবেশনা শেষে তবলা নিয়ে মঞ্চে আসেন ভারতের নীলেশ রণদেব। পন্ডিত সুরেশ তালওয়ালকারের শিষ্য এ শিল্পী বিশ্বের বিভিন্ন বড় সঙ্গীত উৎসবে অংশ নিয়েছেন। খেয়াল পরিবেশন করেন কিরানা ঘরনার কণ্ঠশিল্পী জয়তীর্থ মেউন্ডি। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ‘ইয়াং মায়েস্ত্রো ইন মিউজিক’ পুরস্কার পাওয়া এ শিল্পীর পরিবেশনা খেয়ালে ভিন্নতার আমেজ এনে দেয়। এরপর ছিল পন্ডিত যোগেশ শামসি ও পন্ডিত শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের তবলার যুগলবন্দি। ভীষণ উপভোগ্য ছিল তাদের পরিবেশনা। চতুর্থ রাতের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কর্ণাটকি কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী দুই বোন রঞ্জনি বালসুব্রক্ষ্মণ্যন ও গায়ত্রী বালসুব্রক্ষ্মণ্যনের যুগল পরিবেশনা। শিল্পীদ্বয়ের স্বাতন্ত্র্য গায়কী ছুঁয়ে যায় সঙ্গীতপ্রেমীদের মন।

কর্ণাটকি কণ্ঠসংগীতে যখন উপস্থিত সংগীত পিয়াসুদের মন-উচাটন তখনই সরোদ নিয়ে মঞ্চে আসেন পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। স্বনামধন্য সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের কৌশলগত দক্ষতা এবং ধ্রুপদ, তন্ত্রকারী ও বিভিন্ন গায়কীর উপাদানে সমুজ্জ্বল ছিলো পরিবেশনাটি। চতুর্থ রজনীর শেষ পরিবেশনা ছিলো এই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আসরের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল।

আজ এ উৎসবে সমাপনী ও পঞ্চম দিন সোমবার দলীয় কন্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগের শিল্পীরা। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনাবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। আবারো সন্তুরের মোহনীয় সুরে ভাসাবেন পন্ডিত শিব কুমার শর্মা। কুমার মারদুর শোনাবেন খেয়াল। সেতার পরিবেশন করবেন পন্ডিত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশন করবেন আরতী অঙ্কালিকার। পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে সুরে শেষ হবে এই উৎসব।

সমাপনী আনুষ্ঠানিকতায় প্রধান অতিথি থাকবেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত থাকবেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। সভাপতিত্ব করবেন প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।