Menu

নৃত্যে শুরু বাঁশিতে শেষ

thumbnail গতকাল উৎসবের শেষ দিনে অধিবেশন শুরু হয় ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র পরিবেশন করেন নৃত্যের কারিশমা। ছবি : কালের কণ্ঠ

উচ্চাঙ্গসংগীতের ঐতিহ্য আমাদের অনেক পুরনো। চর্চা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হালে সেই ঐতিহ্য খানিকটা মলিন। সেভাবে বেরিয়ে আসেনি প্রতিভা। শ্রোতার আগ্রহ আর পরিসংখ্যানও সেভাবে আলোচনায় আসেনি। তবে ভালো আয়োজন হলে শ্রোতার অভাব নেই—বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব তা প্রমাণ করল আবারও। গতকাল শনিবার ছিল পঞ্চরজনীর উৎসবের সমাপনী রাত। পাঁচ রাতেই রাজধানীর ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে ভিড় করেছে নানা শ্রেণির সংগীতপিপাসুরা। তাদের অংশগ্রহণে গোটা আয়োজন ছিল প্রাণবন্ত, উৎসবমুখর।

রাজধানীর বনানীতে পাঁচ বছর ধরে আয়োজন হয়ে এসেছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। এবার তা বসেছিল ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে। ভেন্যু পরিবর্তিত হলেও তাতে উৎসবে ছন্দপতন ঘটেনি। এই উৎসব দর্শক-শ্রোতার মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যে প্রতিবছর উৎসবের জন্য প্রতীক্ষায় থাকে অনেকেই। এবারও বিপুল দর্শক-শ্রোতার সরব উপস্থিতি আর সুরের মূর্ছনায় মাতোয়ারা হওয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

নিজ নিজ ক্ষেত্রে জীবন্ত কিংবদন্তি দেশি-বিদেশি শিল্পীরা সুর-তাল-ছন্দের ঝঙ্কারে আগের বছরগুলোতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গতকাল উৎসবের শেষ দিনে অধিবেশন শুরু হয় ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র পরিবেশন করেন নৃত্যের কারিশমা। সবশেষে ছিল ‘বাঁশির ঈশ্বর’ পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। তাঁর বাঁশির সুরেই পর্দা নামে এবারের উৎসবের।

সুজাতার পরিবেশিত ‘অর্ধনারীশ্বর’ নৃত্যের মধ্য দিয়ে গতকাল আবাহনী মাঠে শুরু হয় শেষরাত্রির পরিবেশনা। তাঁর নৃত্যের মুদ্রাগুলো যেন ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল চোখ। নাচের মুদ্রার মধ্য দিয়ে নিঃশব্দ কথোপকথন চলছিল দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হাজারো দর্শক। আর চারদিকে মুগ্ধতা ছড়িয়ে নেচে যাচ্ছিলেন বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র।

রাগ মল্লিকা ও তাল মল্লিকার এই পরিবেশনার নৃত্যরচনা ও পরিচালনা করেছেন পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র এবং সংগীতে ছিলেন পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্র। এরপর তাঁর পরিবেশনা ছিল ‘রামায়ন-লঙ’। নৃত্যের এ অংশটি ভক্ত কবি জগন্নাথ দাস রচিত ওড়িশি রামায়ণ থেকে নেওয়া। এটি মূলত একটি নৃত্যনাট্যের অংশবিশেষ। এটি পরিচালনা করেছেন গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্র।

নৃত্য শেষে শুরু হয় উৎসবের সমাপনী অধিবেশন। এ অংশে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক স্যার ফজলে হাসান আবেদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ছায়ানটের সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুন, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং আবাহনী লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী নাবিল আহমেদের পক্ষে তাঁর মা আমিনা আহমেদ।

সভাপতির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া উচ্চাঙ্গসংগীতের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের কাজ করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় প্রতিবছর এই উৎসব নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, এটাও গর্বের ব্যাপার। যত দিন বেঁচে আছি তত দিন এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারলে আরো ভালো লাগবে।’

প্রধান অতিথি স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘শিল্প-সাহিত্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ। তাই অনেক আশঙ্কা কাটিয়ে এই উৎসব আয়োজন করতে পারা অনেক ইতিবাচক ব্যাপার।’

ড. সন্জীদা খাতুন বলেন, ‘উৎসব আমাদের জন্য খুব জরুরি। কিন্তু শুধু ঢাকায় উৎসব আয়োজন করলে হবে না। সংগীত ও সংস্কৃতির এ ধরনের উৎসব সারা দেশে নিয়ে যেতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের হারানো ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই আমাদের মধ্যে মমত্ববোধ জেগে উঠবে। কারণ মানুষকে ভালোবাসতে পারাই মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ।’

সমাপনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। তিনি অনুষ্ঠান আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং আয়োজনের সহযোগী সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। কিন্তু এই উৎসব আয়োজনের সব পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।’ সবশেষে তিনি বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা না থাকলে আমরা এই উৎসব আয়োজন করতে পারতাম না।’

এরপর পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট মঞ্চে আসেন মোহন বীণা হাতে। ২০ তারের হাওয়াইন গিটারসদৃশ যন্ত্রটিতে তিনি সুর তোলেন। এরপর কণ্ঠে সুর ছড়িয়ে দিয়ে খেয়াল পরিবেশন করেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। বিঞ্চুপুর ঘরানার এই শিল্পীর পরিবেশনা শেষে মঞ্চে যৌথ সেতার-বাদনে অংশ নেন উত্তর ভারতের শিল্পী পণ্ডিত কুশল দাস ও সেনিয়া মাইহার ঘরানার শিল্পী কল্যাণজিত দাস। পণ্ডিত কৈবল্যকুমার এরপর সেতার-বাদন করেন। কিরানা ঘরানার তৃতীয় প্রজন্মের এই সংগীত প্রতিভা তাঁর স্বভাবসুলভ তাল পরিবেশন করেন। উৎসবের সবশেষে ছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি বাদন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবের এবারের আয়োজন।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞদের পরিবেশনার পাশাপাশি উৎসব প্রাঙ্গণে আরো ছিল বাংলাদেশের সংগীত সাধক ও তাঁদের জীবনী নিয়ে সচিত্র প্রদর্শনী। এ ছাড়া বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটলমেন্ট আয়োজন করে ‘সাধারণের জায়গা’ শীর্ষক স্থাপত্য প্রদর্শনী।

শুক্রবার মধ্যরাতের পরিবেশনা : শুক্রবার মধ্যরাতে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খানের খেয়াল শেষে ছিল সরোদ ও বেহালার যুগলবন্দি। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ একসঙ্গে পরিবেশন করেন রাগ সিমেন্দ্রমধ্যমম। তাঁদের সঙ্গে তবলায় সংগত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি। মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার। এরপর খেয়াল পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত যশরাজ। তিনি প্রথমে রাগ যোগ-এ খেয়াল পরিবেশন করেন। এরপর ছিল দুর্গা রাগে ভজন পরিবেশনা। তাঁকে তবলায় সংগত করেন রামকুমার মিশ্র, হারমোনিয়ামে পণ্ডিতা তৃপ্তি মুখার্জি, কণ্ঠে রত্তন মোহন শর্মা এবং মৃদঙ্গমে শ্রীধার পার্থসারথী। খেয়াল শেষে প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে চেলোর পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। তিনি রাগ নন্দকোষ পরিবেশন করেন। তাঁর পরের পরিবেশনা ছিল ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’—এ দুটি রবীন্দ্রসংগীত। তবলায় ছিলেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডু ও টিংকু কুমার শীল। উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির সেতার। তিনি রাগ ললিত বিস্তার গৎ ঝালা পরিবেশন করেন। তবলায় সংগত করেন সৌমেন নন্দী।

এবারের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সম্প্রচার সহযোগী ছিল চ্যানেল আই, মেডিক্যাল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা ব্লুজ কমিউনিকেশনস এবং আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল সিঙ্গাপুরের পারফেক্ট হারমনি।

 

View Full Article