নৃত্য ও খেয়ালের রাত
কখনো শাস্ত্রীয় নৃত্যের ঝংকার, কখনো ধ্রুপদি খেয়ালের সুর, কখনো বা সরোদ ও সেতারের মায়াবী ছন্দ, আবার কখনো বেহালার করুণ টান যেন সবাইকে টেনে নিয়ে এসেছিল আবাহনী মাঠে। রাতের গভীরতার সঙ্গে বাড়ছিল পৌষের হিমেল হাওয়া, তা উপেক্ষা করেই দর্শক-শ্রোতা নিমগ্ন হয়েছিল সুরের ইন্দ্রজালে।
গতকাল শুক্রবার ছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ রাত। ছুটির দিনে গতকাল শ্রোতার উপস্থিতিও ছিল প্রচুর। রাত ১০টা বাজার আগেই পূর্ণ হয়ে যায় আসনগুলো। শুরুতে ছিল দেশের শিল্পীদের শাস্ত্রীয় নৃত্যের জমকালো পরিবেশনা। ছিল দুই বিখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ রশিদ খান ও পণ্ডিত যশরাজের খেয়ালের মনোজ্ঞ পরিবেশনা। নৃত্যের ছন্দে ও খেয়ালের মায়াবী সুরে উপস্থিত হাজারো দর্শক যেন মুহৃর্তেই বুঁদ হয়ে গিয়েছিল। দর্শকের হৃদয় ভরে উঠেছিল ভালোবাসা ও শান্তির আবেশে।
তিন ঘরানার শাস্ত্রীয় নাচের সম্মিলনে শুরু হয় গতকালের উৎসব। মণিপুরি, কত্থক ও ভরতনাট্যমের নৃত্যশৈলীতে জুড়ায় দর্শকের নয়ন। দেশের শিল্পীদের পরিবেশিত তিন আঙ্গিকের সম্মিলিত পরিবেশনার শিরোনাম ছিল ‘নৃত্য চিরন্তন’। মুদ্রার সঙ্গে অভিব্যক্তির অনবদ্য সম্মিলনে যৌথ পরিবেশনাটি উপস্থাপন করেন নবীন নৃত্যশিল্পী সুইটি দাস, অমিত চৌধুরী, স্নাতা শাহরিন, সুদেষ্ণা স্বয়মপ্রভা, মেহরাজ হক ও জুয়াইরিয়াহ মৌলি। পরিবেশনাটির তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় ছিলেন নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসংগীতে সাজানো নৃত্যের কম্পোজিশনে ছিলেন বিম্বাবতী দেবী, গুরু বিপিন সিং, কীর্তি রাম গোপাল ও শিবলী মহম্মদ। মণিপুরি নৃত্য পরিবেশন করেন সুইটি দাস ও সুদেষ্ণা স্বয়মপ্রভা। তাঁরা পরিবেশন করেন লাস্য ও তাণ্ডব। ভরতনাট্যমে অমিত চৌধুরী ও জুয়াইরিয়াহ মৌলি পরিবেশন করেন সূর্যকৌত্থুয়াম ও শিবাকৃতি। কত্থকে স্নাতা শাহরিন ও মেহরাজ হক পরিবেশন করেন বন্দনা ও তারানা।
নৃত্যের ঝংকার শেষে সরোদের সুর ছড়িয়েছেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের পরিচালনায় সরোদ পরিবেশন করেন ইলহাম ফুলঝুরি খান, ইশরা ফুলঝুরি খান, আম্ববারিশ দাস ও সাদ্দাম হুসেন।
উৎসবের চতুর্থ দিনের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রশিদ খানের মনোমুগ্ধকর খেয়ালের পরিবেশনা। ভারতের রামপুর-সাহাশন ঘরানার অন্যতম ধারক তিনি। ওস্তাদ এনায়েত হুসাইন খান এবং তাঁর ভাগ্নে ওস্তাদ গোলাম মোস্তফা খানের পর তিনি এ ঘরানার প্রচার ও প্রসারে কাজ করছেন। সারগাম ও সারগাম তানকারির সঙ্গে বিলম্বিত খেয়াল পরিবেশনের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।
রশিদ খানের খেয়ালের সুর থামতেই সরোদের সুরে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করেছেন মাইহার ঘরানার পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মাইহার ঘরানার সরোদ পরিবেশন ও কারিগরি দক্ষতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন মজুমদার। ধ্রুপদ তন্ত্রকারী এবং গায়কি ঘরানায় তাঁর সরোদবাদন মুগ্ধ করে দর্শকদের।
এরপর মঞ্চে আসেন ভারতের প্রখ্যাত বেহালাবাদক ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ। বেহালায় শাস্ত্রীয় ভারতীয় সংগীত পরিবেশন করেন তিনি।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের খেয়ালে যে কয়জন হাতে গোনা জীবন্ত দিকপাল রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম পণ্ডিত যশরাজ। শাস্ত্রীয় সংগীতের যশস্বী এই শিল্পী প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের মঞ্চে গতকাল খেয়াল পরিবেশন করেন।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পরিবেশনা : বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সরোদে সুর ছড়িয়েছেন শিল্পী আবির হোসেন। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন যোগেশ শামসি এবং তানপুরায় অভিজিৎ দাশ। শিল্পী পরিবেশন করেন রাগ আভোগী।
এরপর বাঁশি নিয়ে মঞ্চে আসেন গাজী আবদুল হাকিম। তিনি দেশ রাগ, পিলু ঠুমরি ও কয়েকটি ধুন পরিবেশন করেন। তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করেন দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি এবং তানপুরায় ছিলেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী সামীন ইয়াসার ও এস এম আশিক আলভি। বাঁশির পর ধ্রুপদ সংগীতে দর্শক-শ্রোতাকে মোহিত করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের সনাতন ধারার বিশিষ্ট পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর। তিনি পরিবেশন করেন রাগ মাড়ু ও রাগ তিলং। তাঁর সঙ্গে পাখোয়াজে সংগত করেন সুখাদ মুণ্ডে এবং তানপুরায় ছিলেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডু ও টিংকু কুমার শীল।
সমাপনী দিনের উৎসব : আজ শনিবার উৎসবের শেষ দিন। সমাপনী আয়োজন শুরু হবে ওড়িশি নৃত্যের আশ্রয়ে। পরিবেশন করবেন বিদূষী সুজাতা মহাপাত্র। এরপর মোহনবীণায় সুর তুলবেন পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। খেয়াল পরিবেশন করবেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। যৌথভাবে সেতার বাজাবেন পণ্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণজিত দাস। এককভাবে সেতারে সুর তুলবেন পণ্ডিত কৈবল্যকুমার। আগের কয়েকটি উৎসবে শ্রোতাকে আলোড়িত করা পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে শেষ হবে ষষ্ঠ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব।