পর্দা উঠলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের
কাগজ বিনোদন প্রতিবেদক: শুরু হলো উচ্চাঙ্গসংগীতের মহাযজ্ঞ। সংগীতপিপাসুরা ভাসতে শুরু করলেন সুরের সাম্পানে। বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে পঞ্চমবারের মতো শুরু হলো পাঁচ দিনের এই সুরেলা আয়োজন।
শুরুতে প্রদীপের আলোকচ্ছটায় অভিবাদন জানানো হয় দর্শক-শ্রোতাদের। এরপর থেকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে উপভোগ করা যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভারতের বর্ষীয়ান ও উদীয়মান শিল্পীদের পরিবেশনা।
রবি-করোজ্জ্বল নৃত্যমালিকা
শিল্পের অপরাপর মাধ্যমের মতো নৃত্যকেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখেছিলেন জীবনের সমগ্রতায়। বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী দর্শনের সূত্রে নৃত্যরূপের কাঠামো ও প্রাণের গভীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন নৃত্যধারার মধ্য থেকে তিনি ছেঁকে তুলেছিলেন সেই নির্যাস যা একান্তভাবে রাবিন্দ্রীক, সেই সঙ্গে বাঙালিরও বটে। নৃত্যশৈলীর নানা ধারা রবীন্দ্রনাথে এসে মিলেছিলো যে মোহনায় তার উৎস ও পরম্পরা দিয়ে গাঁথা হয়েছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের উদ্বোধনী পরিবেশনা ‘রবি-করোজ্জ্বল নৃত্যমালিকা’।
পরিবেশনার দ্বিতীয় অংশে ছিল মণিপুরী নৃত্য। এরপর একে একে ভরতনাট্যম, প্রদীপনাচ, রাধাকৃষ্ণ, পুংচালাম, ওড়িশি ও কত্থক আঙ্গিক, রবীন্দ্র নৃত্যভাবনা এবং বাংলাদেশে যে কটি শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রচলিত এবং চর্চিত সেগুলো অবলম্বনে নৃত্য পরিবেশন করেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল নৃত্যনন্দন। এরপর শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।
উদ্বোধনী দিনে দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিলো প্রবীণ গোদখিণ্ডি ও রাতিশ টাগডের বাঁশি ও বেহালার যুগলবন্দি। তারা পরিবেশন করেন রাগ মারু বিহাগ ও হংসধ্বনি। তবলায় ছিলেন রামদাস পালসুল। তাদের হাতে স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি শাহ সৈয়দ কামাল।
প্রথম দিনের আয়োজনে খেয়াল পরিবেশন করেছেন বিদুষী গিরিজা দেবী। সঙ্গে তবলায় ছিলেন গোপাল মিশ্র। সরোদ পরিবেশন করেন ওস্তাদ আশিষ খান। তাকে তবলায় সঙ্গত করবেন পন্ডিত বিক্রম ঘোষ। খেয়াল যুগলবন্দি ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করবেন বিদুষী অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে ও পন্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর। তাদের সঙ্গে তবলায় থাকবেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার। বেহালা পরিবেশন করবেন ড. এল সুব্রহ্ম্যণন। তবলায় সঙ্গ দেবেন পন্ডিত তন্ময় বোস।
শ্রদ্ধায়, স্মরণে
এ বছর উৎসবটি উৎর্সগ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশ্যে। শাস্ত্রীয় সংগীতের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রয়াত বালমুরালি কৃষ্ণ ও ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় উৎসবে। দুই দিন আগে পরলোকগমন করেছেন বালমুরালি। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ আসরে তিনি মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন। ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেনের সানাই পরিবেশনা ছিলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের প্রথম আসরে।
উদ্বোধনী মঞ্চ
পঞ্চম বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, ‘এবারের উৎসবের সবচেয়ে বড় অর্জন ৮৭ বছর বয়সী বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা।’
যোগ করে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘উচ্চাঙ্গসংগীত অনুধাবন করতে হলে কান প্রস্তুত করতে হয়। এজন্য সময় লাগে। যার কান তৈরি হয়ে যায় সে কখনও হিংস্র হতে পারে না। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন এই উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারা।’
হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে আবৃত্তি
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর হলি আর্টিজান, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রুচিশীল মানুষদেরই। সন্তানদের মাঝে বুনে দিতে হবে আমাদের সংস্কৃতির বীজ।’ সবশেষে হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে তারিক সুজার লেখা কবিতা ‘জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’ আবৃত্তি করে শোনান তিনি।
সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু বলেন, ‘সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার প্রতি এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আমাদের এই উৎসব।’ মঞ্চে উপবিষ্ট অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিস্তারে দেশের প্রতিটি গ্রামে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক ক্লাব করে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
টিভি চ্যানেলে এক ঘণ্টা করে উচ্চাঙ্গসংগীত!
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেল যদি প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে উচ্চাঙ্গসংগীতের জন্য বরাদ্দ করে তাহলে আমাদের উদ্যোগের মাধ্যমে যেসব শিল্পী তৈরি হবে তাদের কর্মসংস্থান হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন মানুষ যদি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে উচ্চাঙ্গসংগীত শোনে, তাহলে সে কখনও খারাপ কাজ করতে পারে না।’
সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের অন্যতম বিশেষত্ব- প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান শিল্পীদের একই মঞ্চে এনে উচ্চাঙ্গসংগীতের দুয়ার সবার কাছে খুলে দিতে পারা। আমি বিশ্বাস করি, এই অনুষ্ঠান ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন। বক্তব্য শেষে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অতিথিদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উপস্থাপক ও সাংবাদিক মিথিলা ফারজানা।
শুধুই সংগীত নয়
২৮ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে উৎসব চলবে রাতব্যাপী। সংগীত পিপাসা মেটানোর পাশাপাশি শ্রোতাদের জন্য খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে উৎসব প্রাঙ্গণে। এ ছাড়া রয়েছে অরণ্য, বেঙ্গল ক্রিয়েশন্স, ম্যাংগো মোবাইল, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপ ও সেটলমেন্টের প্রদর্শনী। আছে এটিএম বুথ। সাংবাদিকদের জন্য আছে ওয়াইফাই জোন।