Menu

বাংলাদেশের সংগীত বৈচিত্র্যের অমিত ধারা 2013

thumbnail

বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলা তার অধিবাসীদের দিয়েছিল যেন দুটি মহত্তম প্রতিশ্রম্নতি। তার পলিবিধৌত ভূমি দিয়েছিল অফুরমত্ম শস্যের দানা। আর এই ভূমির শরীরে সর্বত্র এঁকেবেঁকে যাওয়া অজস্র নদী, সীমাহীন সবুজ প্রামত্মর তার সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠে দিয়েছিল বিচিত্র সংগীতের অনমত্মধারা। নদীমাতৃক উর্বর ভূমির সবুজ এদেশ যেন সংগীতের জন্য আদিকাল থেকেই উর্বর। বাংলার সংগীতভা-ার তাই সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ গানের দেশ। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে সংগীত অনুশীলন হয়ে আসছে। গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের রাজত্বকালে বাংলাদেশে পদ্ধতিগতভাবেই সংগীতের অনুশীলন হতো।

বাংলা ভাষা ও সংগীতের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ। এটি মূলত ৪৭টি গানের সংকলন। খ্রিষ্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে গানগুলো রচিত। সে-যুগে সংগীতকে প্রবন্ধগীত বলা হতো। চর্যাগুলো ছিল প্রবন্ধগীত। চর্যাগীতিগুলো বিভিন্ন রাগ-রাগিণীতে গাওয়া হতো। পটমঞ্জরী, মলস্নারী, গুর্জরী, কামোদ, বরাড়ী, ভৈরবী, গবড়া, দেশাখ, রামক্রী, শবরী, অরম্ন, ইন্দ্রতাল, দেবক্রী, ধানশ্রী, মালসী, মালসী-গবড়া ও বঙ্গাল রাগ। এর সঙ্গে পটহ বা ঢোল এবং একতারা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চর্যাগীতিগুলোতে ব্যবহৃত রাগগুলোর দীর্ঘ তালিকা দেওয়ার কারণ হলো হাজার বছর অতীতে যেসব রাগ-রাগিণী গাওয়া হতো তার প্রায় অধিকাংশই আজো আমাদের সংগীতে টিকে আছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সেসব রাগের কিছু রাগ-রূপের ও গায়নশৈলীর হয়তো পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাভাষী অঞ্চলে যে হাজার বছর আগেও রাগসংগীতের চর্চা ছিল, তা চর্যায় এইসব রাগ-রাগিণীর উলেস্নখ থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি। রাগ পটমঞ্জরী, পাহাড়ী, ভৈরবী, কামোদ, রামক্রী বা রামকেলি, মলøvরী বা মলøvর রাগে এ যুগেও সংগীত পরিবেশন করা হয়। চর্যার পরে বাংলা সংগীতের ÿÿত্রে উলেস্নখযোগ্য হচেছ নাথগীতি, যা চর্যাপদের সমসাময়িক। নাথ ধর্মের উৎপত্তি দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে। নাথগীতির রচয়িতা হাড়িপা, কাহ্নপা প্রমুখ। কাহ্নপার রচনা চর্যাপদেও পাওয়া যায়। নাথগীতিতে রাগের ব্যবহার থাকলেও সম্ভবত তা ছড়ার আকারে গাওয়া হতো।
চর্যাগীতির পর সংগীতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে জয়দেবের গীতগোবিন্দম। দ্বাদশ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত গীতগোবিন্দ কাব্যগ্রন্থ ও সংগীতশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে সমাদৃত। জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি। রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত গীতগোবিন্দের গানগুলোও চর্যাগীতির মতোই বিভিন্ন রাগে গাওয়া হতো এবং তার সঙ্গে ব্যবহৃত হতো রূপক, নিঃসার, যতি, একতাল এবং অষ্টতাল। গীতগোবিন্দে ব্যবহৃত রাগ ভৈরবী, বিভাস, বসমত্ম, দেশ প্রভৃতি একই নামে বর্তমানকালেও রাগসংগীতে প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে শুদ্ধস্বরের বিভাস রাগ আছে, যা লোকসুরে গাওয়া হয়। গীতগোবিন্দে ব্যবহৃত তাল বাংলা কীর্তনে এখনো ব্যবহৃত হয়। বাংলা কীর্তনে কর্নাট রাগের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
লক্ষ্মণ সেনের সময় সমুদ্র গুপ্তের বীণাবাদনে রাজসভা মূর্ত হতো। তাঁর উচ্চমানের বাদন তখনকার সংগীতসম্রাটদেরও তাঁদের নিজ দÿতার বিষয়ে কুণ্ঠিত করত, সে-কথা তাম্রশাসনে উলেস্নখ আছে। লক্ষ্মণ সেনের দরবারে খ্রিষ্টীয় বারো শতকে পদ্মা বাই গান্ধার রাগ পরিবেশন করে সভাকে বিমোহিত করেছিলেন এবং সেই সময় দরবারের সংগীতাচার্য কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ, খাম্বাজ, গান্ধার প্রভৃতি রাগ উপমহাদেশের সর্বত্র গাওয়া হতো।
এই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সংগীত ইতিহাসে ‘বজ্রগীতি ও চর্যাগীতি’ উলেস্নখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাবের প্রায় আগেই বাংলা ও পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংকীর্তনের গান পরিবেশন করতেন। চর্যাগীতি ও বজ্রগীতি – এ দুটি বাংলাদেশের নিজস্ব নিবন্ধ প্রবন্ধ বৌদ্ধগীতি তথা ক্লাসিক্যাল অভিধানযুক্ত অভিঘাতপদ গান।
বাংলায় শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে কীর্তন আন্দোলন শুরম্ন হয় এবং গীতগোবিন্দের পদগুলো কীর্তনাকারে গাওয়ার প্রচলন শুরম্ন হয়। বাংলা সংগীতকলার উলেস্নখযোগ্য নিদর্শন বড়ু চ-ীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মোট ৩২টি রাগ-রাগিণীর উলেস্নখ পাওয়া যায়। গীতগোবিন্দে যেসব তালের উলেস্নখ আছে তা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও পাওয়া যায়। বাংলা সংগীতের ÿÿত্রে বিদ্যাপতির অবদান অপরিসীম। বৈষ্ণব পদাবলী তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। ভক্তিরস ও মানবিক প্রেম এই পদাবলীর মূল উপজীব্য। বিদ্যাপতির এক শতাব্দী পরে বাংলার বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের আবির্ভাব ঘটে। তিনি মূলত বিদ্যাপতিকেই অনুসরণ করেছিলেন। স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাপতি ও গোবিন্দ দাসের ভক্ত ছিলেন। তিনি তাঁদের দুজনের লিখিত পদে সুরারোপ করে নিজ সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছিলেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব পদাবলীর উদ্ভব হয়েছিল। বাঙালির মানবতাবোধ উজ্জীবিত করতে বৈষ্ণব পদাবলী এক বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। বৈষ্ণব মতবাদের প্রভাবে সহজিয়া ও বাউল মতবাদ পরিপুষ্ট হয়েছিল। রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়ভিত্তিক রচিত পদগুলো কীর্তন নামে খ্যাত। এই কীর্তনকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়, যথা নামসংকীর্তন ও রসকীর্তন বা লীলাকীর্তন। কীর্তনের নানা অঙ্গ। কীর্তনের একটি অঙ্গ ঝুমুরের ব্যবহার বাংলা লোকসংগীত ও আধুনিক গানে লÿ করা যায়। ষোলো শতকের শেষদিকে কীর্তন সারা বাংলাদেশে বিসত্মার লাভ করে।
পনেরো থেকে আঠারো শতাব্দী পর্যমত্ম মঙ্গলকাব্যের যুগ বলা যায়। মঙ্গলসূচক পদ বা পঙ্ক্তিমালার সমষ্টিই মঙ্গলকাব্য। বিশেষ সুরে বিভিন্ন রাগে নানা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে তা গাওয়া হতো।
নানা রাগসংগীতের পাশাপাশি বাংলাদেশ তার নিজস্ব একটি সুরের ধারা সর্বকালেই জাগরূক রেখেছিল। এই সুরধারা মনসা মঙ্গলে তথা বেহুলা কাব্যে বাঙ্গাল রাগ নামে উলেস্নখ করা হয়েছে, যা আমাদের কাছে রাগ ভাটিয়ারি নামে পরিচিত।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে বৃহৎ বঙ্গে রামানন্দ ও কবীর দোঁহা এবং সখীর মাধ্যমে সংগীতে এক নবধারা এসেছিল। বৈষ্ণব পদের ‘কৃষ্ণকীর্তন ও কালীকীর্তন’ – এ দুই ধারা বাংলাদেশের চ-ীম-পগুলোকে মুখরিত রাখত। রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমলীলা নিয়ে রচিত পদাবলী কীর্তন, ষোলোশো শতকে লীলাকীর্তন গাওয়া হতো রাগের আশ্রয়ে। অন্যান্য অঞ্চলের কীর্তনগীতি থেকে বাংলাদেশের পদাবলী কীর্তন রূপে-রসে-বিকাশে এ অঞ্চলের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের পদাবলী কীর্তন বাঙালি জাতির নিজস্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। তারও আগে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হতো রাগ, তাল ও ভাবের সমাহারে। বাংলায় গাওয়া হতো রাগাশ্রয়ী বিভিন্ন শ্রেণীর গান। নানা রাগ, তাল, ছন্দ ও লয়ে গাওয়া হতো পালাগান, মনসাগান, পদগান, ঝুমুর, চ-ীর গান, রামপ্রসাদি, বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মারফতি, মুর্শিদি, গম্ভীরা, বারানসি, মণিপুরীসহ নানা ধারার গান। পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও মৈমনসিংহ গীতিকার সংগৃহীত গান বাংলার সমৃদ্ধ সংগীতভা-ারের প্রমাণস্বরূপ। পাল রাজাদের সময়ে গ্রাম্যগীতি (পলস্নীগীতি) রচনার প্রমাণ তাম্রশাসনে বা বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়।
প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে রাগসংগীত প্রকৃত অর্থেই যেমন রাজদরবারে স্থান পেয়েছে এবং পেয়েছে পৃষ্ঠপোষকতা, তেমনি রাগগুলো লোকসংগীতের নানা শাখায় নানা অংশে যেমন পদ, পাচালী, কীর্তন, পদাবলী, জারি, সারি, ভাটিয়ালি ইত্যাদিতে প্রত্যÿ বা পরোÿভাবে অঙ্গীভূত হয়ে যুগে যুগে গণমানুষের সংগীতের মধ্য দিয়ে নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত হয়েছে। বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস ওসত্মাদ আলাউদ্দিন খাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ওসত্মাদ আলাউদ্দিন খাঁ বলতেন, উচ্চাঙ্গসংগীত ও পলস্নীসংগীত পরস্পরের পরিপূরক। তিনি বলতেন, সিলেটের হোরিগান বলে প্রচলিত লোকসংগীতের সুরের মধ্যে রাগসংগীতের এক অদ্ভুত সমন্বয় দেখা যায়। একদিকে সুরের ধ্রম্নপদী বিন্যাসে এবং লয়ে তাল-ফেরের চলনে, আবার অন্যদিকে সাধারণ লোকের সমবেত কণ্ঠের সহজ অভিব্যক্তিতে এই গান এমন এক সামগ্রিক লৌকিক রূপ ধারণ করেছে যে, লোকসংগীতে রাগের সাবলীল মিশ্রণের এ রকম দৃষ্টামত্ম অতি বিরল। তিনি তাঁর ছোটবেলায় গাওয়া একটি গানের উলেস্নখ করলেন, ‘নিরলে কইয়ো গিয়া বন্ধুয়ার লাগ পাইলে’ – এই গানটি একই সুরে দুই গায়কীতে তিনি গেয়ে বললেন, এক গায়কীতে এটি লোকসংগীত, আবার অন্য গায়কীতে একেই উচ্চাঙ্গসংগীতের শ্রেণীতে ফেলা যায়।
মুসলমান বিজয়ের আগেই বাংলাদেশের সমাজজীবনে গীতিগাথা ও দোহার আবরণে গীত, বাদ্য ও নৃত্যের সম্মিলনে বিশুদ্ধ সংগীতের প্রচলন ছিল। এদেশে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগে থেকেই যে সুফি-সাধকদের আগমনের একটা ধারা প্রবহমান ছিল তা মোগল আমলেও অব্যাহত ছিল। এসব সুফি সম্প্রদায় বাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিসত্মার করে। বাংলা ভাষায় তাদের মতবাদ প্রচার ও প্রসার লাভ করে এবং এর প্রভাবে বাংলার সংগীত এক ভিন্ন নবচেতনা লাভ করে। গজল ও মুর্শিদি গানে বাংলার নদী-প্রামত্মর মুখরিত হয়ে ওঠে। হিন্দুদের সত্যপীর বা সত্যনারায়ণ মাহাত্ম্য এবং মুসলমানদের যোগ কলন্দর – এই দুই কালজয়ী রচনা সুফি প্রভাবেই সম্ভব হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতকে বিষ্ণুপুরে রামশঙ্কর ভট্টাচার্য বাংলায় সর্বপ্রথম ধ্রম্নপদ চর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তিনি একটি স্বতন্ত্র ঘরানা অর্থাৎ বিষ্ণুপুর ঘরানা তৈরি করতে সÿম হয়েছিলেন। বাংলার আদি ধ্রম্নপদ গপী রামশঙ্কর ও তাঁর শিষ্যম-লী বাংলা ভাষায় ধ্রম্নপদ রচনা ও তার ব্যাপক প্রচলন করতে সÿম হয়েছিলেন। বিখ্যাত ওসত্মাদ কাশেম আলী খাঁ ও যদুভট্ট বিষ্ণুপুরে রামশঙ্করের শিষ্য ছিলেন।
মোগল সাম্রাজের পতনের পর দিলিস্ন থেকে সেনিয়া কলাবমত্ম বাহাদুর খাঁ ও মৃদঙ্গি পীরবক্স বিষ্ণুপুরে কয়েক বছর অধিষ্ঠান করেন। সেই সময় থেকেই পূর্ব বাংলায় উচ্চাঙ্গসংগীতের বিকাশে এক নব উদ্যোগ সূচিত হয়। মোগল আমলের শেষ পর্যায়ে মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার নবাবদের সংগীতের যোগাযোগ ছিল। মোগল সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর পলায়নপর শাহ সুজা পূর্ববঙ্গের ঢাকা, কুমিলস্না ও চট্টগ্রাম হয়ে আরাকানে পালিয়ে যান। সেই সময় তাঁর পারিষদবর্গের মধ্যে খোদা বক্স নামে একজন সেনিয়া কলাবমত্ম ছিলেন। পূর্ব বাংলার কুমিলস্না সংগীতের একটি পীঠস্থান হিসেবে দীর্ঘকাল থেকে পরিচিত। সেখানে উচ্চাঙ্গসংগীতের সূত্রপাত শাহ সুজার পরিষদে থাকা খোদা বক্সের মাধ্যমেই হয়েছিল। ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নাটোরের মহারাজের আমন্ত্রণে সেনিয়া ঘরানার শিষ্য সুবিখ্যাত রসুল বক্স সেখানে অবস্থান করেছিলেন। প্রকৃতপÿÿ পূর্ববঙ্গে উচ্চাঙ্গ, ধ্রম্নপদ ও যন্ত্রসংগীতের প্রকৃত চর্চা শুরম্ন হয় ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্যর দরবারে। তাঁর আমন্ত্রণে প্রখ্যাত সেনিয়া রবাবিয়া কাশিম আলী খাঁ ও তখনকার বাংলার শ্রেষ্ঠ গায়ক ধ্রম্নপদিয়া বঙ্গনাথ যদুভট্ট ত্রিপুরায় অবস্থান করেন। ওই দুজন মহাগুণীর আবির্ভাবে পূর্ববঙ্গে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। যদুভট্ট পরে কলকাতায় ফিরে যান এবং কাশিম আলী খাঁ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের আমন্ত্রণে জয়দেবপুরেই আমৃত্যু থেকে যান। তাঁর অবস্থান ও শিÿাগুণে জয়দেবপুর ও ঢাকায় উচ্চসত্মরের সংগীত গড়ে উঠেছিল। ঢাকার নবাব আহসানউলস্নাহ ও ঢাকার জমিদার ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাসের প্রাসাদে প্রায়ই সংগীত মাহফিলের আয়োজন করা হতো। কাশিম আলী খাঁ ও তাঁর সহযোগী শিষ্য সরোদিয়া ওসত্মাদ এনায়েত হোসেন খাঁ ও তাঁর সংগতিয়া তবলিয়া ওসত্মাদ আতা হুসেন খাঁ ঢাকার এসব মাহফিলে নিয়মিত যোগদান করতেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধিতে ভূষিত হন ২ জানুয়ারি ১৮৭৭ সালে। সেই উপলÿÿ আমন্ত্রিত হয়ে সরোদিয়া এনায়েত হুসেন খাঁ ও তবলিয়া আতা হুসেন খাঁ সর্বপ্রথম ভারতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে লন্ডন যান। আমন্ত্রিত হয়েও বার্ধক্যহেতু কাশিম আলী খাঁ লন্ডন যাননি। এনায়েত হুসেন খাঁর সংগীত শুনে ব্রিটিশ সংগীতশিল্পীরা খানিকটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ভারতীয় সংগীতও শ্রোতৃম-লীকে বিমোহিত করার শক্তি রাখে। ঢাকার নবাব দরবারে সে সময় আচ্ছন বাই ও তাঁর তবলিয়া সুপ্পন খাঁ নিযুক্ত হন। আচ্ছন বাই অতি সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী দÿ গায়িকা ছিলেন। সুপ্পন খাঁ লÿÿনŠর বিখ্যাত তবলিয়া আবেদ হুসেন খাঁর ঘরানার পূর্বপুরম্নষ। ঢাকায় তবলা ঘরানার পত্তন হয় প্রধানত আতা হুসেনের প্রধান শিষ্য প্রসন্ন বণিক এবং সাধু ওসত্মাদ ও তাঁর দুই পুত্র গোলাপ ও মাহতাবের কীর্তিসূত্রে। প্রসন্ন বণিকের অমরকীর্তি তাঁর রচিত তবলা তরঙ্গিনী ও পাখোয়াজ ও মৃদঙ্গ শিÿা দুটি, যা আজো সংগীতের উচ্চ শিখরে সমাদৃত। ঠিক একই সময়ে কাশিম আলী খাঁর কিছু তালিম নিয়ে নিজ প্রতিভাগুণে কিংবদমিত্মতে পরিণত হন সেতারিয়া ভগবান দাস। ঢাকার বসাকদের মধ্যে পাখোয়াজ বাদনের খুবই ভালো চর্চা ছিল। ঢাকার নবাবপুরের বসাকদের কেউ কেউ বিষ্ণুপুরের যদুভট্টের কাছে ধ্রম্নপদ ধামা তালিম নিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে আলোচিত ছিলেন হরি কর্মকার। হরি ও মুরাপাড়ায় জমিদারের নিযুক্ত ইমদাদ হুসেন খাঁ ঢাকাকে গায়নবিদ্যার এক পীঠস্থানে পরিণত করেন। এই নব অনুশীলন ধারার শ্রেষ্ঠ ফসল খেয়ালিয়া ও টপ্পা গায়ক ঢাকার হাসনু মিয়ার শিষ্য হেকিম মোহাম্মদ হোসেন। মোহাম্মদ হোসেন কলকাতার মোরাদ আলী ও ভারতের প্রখ্যাত সংগীতের প্রবাদপুরম্নষ কালে খাঁ এবং রামপুরের বিখ্যাত তসদ্দুক হোসেনের কাছ থেকে তালিম নেন। সংগীতের সকল গুণীর পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ববঙ্গের বেশ কয়েক জমিদার পরিবার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ভাওয়ালের জমিদার, মুরাপাড়ার জমিদার, ঢাকার নবাব পরিবার, ঢাকার রূপলাল ও মধুরানাথ দাসদের অবদান এÿÿত্রে উলেস্নখযোগ্য। ভারত বিখ্যাত মহৎ খেয়ালিয়া বীণকার ওসত্মাদ কালে খাঁ ছিলেন বিখ্যাত ওসত্মাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর চাচা। কালে খাঁ ঢাকার কলুটোলায় থাকতেন। তাঁর পরিবারের কয়েকজন ঢাকায় এসে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইলে তিনি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি প্রায় বলতেন, ‘মেরা মুলকমে কদরদান রইস্ আদমি কাহাঁ হ্যায়। ঢাকাহি মেরে লিয়ে আচ্ছা হ্যায়।’ মুরাপাড়ার জমিদার দরবারে তিনি দরবারি গায়করূপে ঢাকায় ছয়-সাত বছর অতিবাহিত করেছিলেন। ঢাকা হলো গান ও তালের শহর। তাই ঢাকার লেখক হেকিম হাবিবুর রহমান লিখলেন, ‘ঢাকার জনসাধারণের মাঝে বাংলার অন্যান্য স্থানের চেয়ে এই আকাঙÿা (গান-বাজনার) বেশি রয়েছে এবং সব সময়ই তাদের আকাঙÿা অব্যাহত রেখেছে।’ গান গাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার আগে ইন্দুবালা কালী দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘মা, ঢাকা যাচ্ছি, ঢাকা তালের দেশ। তালগান আমার তত রপ্ত নয়। বায়না নিয়েছি যেতে হবে। মান রাখিস মা।’ আর ১৮৪০-এ ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল ডেভিডসন ঢাকাবাসীকে আখ্যায়িত করেছেন ‘মিউজিক্যাল পিপল’ হিসেবে।
‘লÿÿনŠ শহর বিখ্যাত কণ্ঠসংগীতের জন্য, আর ঢাকা তবলা ও সেতারের জন্য। ঢাকার সেতার ও তবলা তাঁর নিজস্ব ঘরানার জন্ম দিয়েছিল।’ – আইনজীবী হৃদয়নাথ মজুমদার উলেস্নখ করলেন তাঁর স্মৃতিকথায়। ১৯৩৯ সালে ঢাকায় বেতার কেন্দ্র স্থাপন ও পরের বছর তা প্রচার শুরম্ন করলে ঢাকা তথা সমগ্র পূর্ব বাংলায় উচ্চাঙ্গসংগীতের এক নবদিগমত্ম খুলে যায়। ভারতের বিভিন্ন স্থানের বহু গুণী ব্যক্তি ঢাকায় যেতে শুরম্ন করেন। ঢাকায় বেতার কেন্দ্র স্থাপন সংগীতজ্ঞ কেশবচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি বলা যায়। ঢাকায় উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচার, প্রসার ও প্রভাব লÿ করে তিনি নিজ উদ্যোগে ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে ঢাকায় বেতার কেন্দ্র স্থাপন করতে রাজি করিয়েছিলেন। ঢাকা ছাড়াও পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে সংগীতে উচ্চধারার প্রচার ও প্রসারে কুমিলস্না, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল উলেস্নখযোগ্য।
পূর্ব বাংলায় উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা ও প্রসার প্রধানত ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে হলেও ময়মনসিংহ জেলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেই উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা শুরম্ন হয়েছিল। উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রসারে বৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের রাজ এস্টেটের জমিদার মহারাজ শশীকামত্ম আচার্য সংগীতানুরাগী ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাঁর দরবারে খেয়ালিয়া প–ত বজরঙ্গ মিশ্র, রামপুরের প্রখ্যাত তবলিয়া ওসত্মাদ মসিৎ খাঁ, কেরামতুলøvহ খাঁ, জিয়ন খাঁ অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুক্তাগাছার জমিদার কুমার জিতেনদ্রকিশোর সংগীত সাধনা, সংগীতজ্ঞানের জন্য বিশেষ পরিচিতি ছিলেন। তাঁর দরবারে রামপুরের প্রখ্যাত খেয়ালিয়া খৈরম্নদ্দিন খাঁ ও মহম্মদ দীন খাঁ অধিষ্ঠিত ছিলেন। জিতেন্দ্রকিশোর বারানসির প্রখ্যাত তবলিয়া প–ত মৌলভী রামমিশ্রকে তাঁর দরবারে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জিতেন্দ্রকিশোর ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের বিভিন্ন রূপরীতির ও রচনার সংগ্রাহক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত ও বিরল সংগীত মহাসম্মেলনের প্রায় সবগুলোতেই তিনি বিচারক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের রাজপরিবারের উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচার ও প্রসার বিষয়ে তাঁদের অবদান সারা ভারতেই বিরল। গৌরীপুরের রাজদরবারে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সেকালের বিখ্যাত সেতারবাদক ওসত্মাদ ইনায়েৎ হুসেন খাঁ এবং বিখ্যাত ওসত্মাদ মহম্মদ আলী খাঁ। ময়মনসিংহ জেলার এই সকল কৃতী জমিদার সংগীতচর্চা ও প্রসারে সাংগীতিক দলিলপত্রাদির সংগ্রহ ও রÿণের এক মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
কুমিলস্নার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংগীতের ÿÿত্রে বিখ্যাত হয়েছিল সংগীতসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর জন্মস্থান এবং তাঁর পরিবারের সংগীতের ÿÿত্রে অবদানের জন্য। সারা উপমহাদেশে যন্ত্রসংগীতের ÿÿত্রে এই পরিবারের অবস্থান ছিল শীর্ষে। একই পরিবারে এত প্রতিথযশা যন্ত্রশিল্পীর আবির্ভাব খুবই বিরল। ভারতীয় সংগীতকে সর্বপ্রথম বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁদেরই। তাঁর পুত্র ওসত্মাদ আলী আকবর খাঁ (সরোদ), জামাতা প–ত রবিশঙ্কর (সেতার), কন্যা রওশন আরা বেগম ওরফে অন্নপূর্ণা (সেতার ও সুরবাহার), ভ্রাতুষ্পুত্র ওসত্মাদ বাহাদুর খান (সেতার ও সরোদ) সংগীতজগতে উজ্জ্বল হয়েছেন।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বিখ্যাত সুরেন্দ্রলাল দাসের উদ্যোগে তিরিশের দশকের শেষের দিকে চট্টগ্রামে প্রথম সংগীত মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সংগীত মহাসম্মেলন সে-সময়ে যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। এই সংগীত সম্মেলনের পর চট্টগ্রামের গুরম্নত্ব সংগীতজগতে যথেষ্ট বেড়ে যায়। এর ফলে ওসত্মাদ আবদুল করিম খাঁ, গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, ওসত্মাদ মুশতাক আলী খাঁ, প–ত রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধিকামোহন মৈত্র, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কিশোর সংগীত পরিবেশনে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। নদীবিধৌত জেলা বরিশালের বীণকার শ্রী বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য পূর্ববঙ্গে কিংবদমিত্মতে পরিণত হয়েছিলেন। বরিশালের তারাপদ চক্রবর্তী, সে-সময়ে তাঁর মতো সুকণ্ঠ গায়ক খুবই বিরল ছিল। শীতল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত এস্রাজবাদক, ধ্রম্নপদ গায়ক বিপিনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামও উলেস্নখযোগ্য। অন্য জেলা শহরগুলোও উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চায় রেখেছিল উলেস্নখযোগ্য অবদান।
এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সংগীতধারা ও রীতি থেকে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের সংগীতধারা ও রীতি আবহমানকাল থেকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ। নদীমাতৃক এদেশে শত স্রোতধারায় যুগ যুগ ধরে যে কত রকমের গীতরীতির প্রচলন রয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রামিত্মক জনগোষ্ঠীর নানা সংগীতধারা যুগে যুগে এই ভা-ারকে করেছে বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। এত বিবিধ সংগীতধারা প্রমাণ করে, বাঙালি জাতি তার স্বকীয় প্রতিভার বিশুদ্ধ সংগীতের অনুশীলন আদিকাল থেকেই করে আসছে।