Menu

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব ’১৬ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে মুগ্ধতার পরশ

thumbnail

কল্পনারও অতীত এক অভিজ্ঞতা। এত বিশাল একটা আয়োজন কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। সারিবদ্ধভাবে মানুষ প্রবেশ করছে ভেন্যুতে। সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ গান শুনছে। রাত যত গভীর হয়েছে, ততই সংগীতপিপাসু মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে। প্রতিদিনই মানুষের বসার জায়গাগুলো ছিল পরিপূর্ণ। শীত উপেক্ষা করে, হলি আর্টিজানে হামলার পর সেই আতঙ্ক কাটিয়ে সবাই এসেছেন আর্মি স্টেডিয়ামে। সামিয়ানার নিচে বসার জায়গা না পেয়ে স্টেডিয়ামের উন্মুক্ত গ্যালারিতে বসে শুনেছেন গান। মানুষের মনে শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি যে এত বিপুল আগ্রহ রয়েছে, তা এই উত্সব আয়োজন না হলে কি বোঝা যেত? বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এই সংগীতপিপাসাকে নতুন করে চিনিয়েছে। গত পাঁচ বছরের আয়োজন শুধু শ্রোতার চাহিদাও মেটায়নি, তরুণ প্রজন্মের মাঝে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখার আগ্রহকেও উসকে দিয়েছে। এখন এই উত্সবে শুধু ভারতের শিল্পীরাই নয়, দেশের তরুণ শিল্পীরাও তাদের গায়কীর মুন্সিয়ানা দেখাচ্ছে সমান তালে। এবছর ২৪ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচদিন ধরে পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত হলো এ উত্সব। ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের অপূর্ব সুরমূর্ছনা মন মাতিয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সংগীত উত্সবে আগত অগণিত দর্শক-শ্রোতাদের।

দেশের মানুষ যখন ঘুমিয়ে তখনো নিশিপাওয়া পাখির মতো জেগে থেকেছে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়াম। সেখানে রাত যত বেড়েছে, গাঢ় হয়েছে হেমন্তের কুয়াশা; ততই আবির ছড়িয়েছে সুরের খেলা। বাতাসে ভেসে কুয়াশার মায়াজাল আর রাতের নির্জনতা ভেঙে ক্ষণে ক্ষণে উঠছিল সুরের অনুরণন। বরেণ্য ওস্তাদদের কণ্ঠমাধুরী, সন্তুর, সেতার, নৃত্যগীত আর বাঁশির পাগল করা সুরলহরীতে যেন ছড়িয়ে পড়ছিল শান্তির সুবাস। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ, বিক্ষুব্ধ মানুষ আর চলমান পাশবিক সহিংসতার মাঝে চারদিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব বাংলাদেশের মানুষের হূদয়ে বুলিয়েছে শান্তির পরশ। কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমি ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ উত্সবের আয়োজন করে।

হেমন্তের কুয়াশাসিক্ত পরিবেশে সুরে সমর্পিত ওস্তাদদের কণ্ঠের মূর্ছনা, নৃত্যগুরুর নূপুরের ঝঙ্কার, যন্ত্রসংগীতের মন মাতানো পরিবেশনা শোনার বিরল সুযোগ—এক কথায় অনবদ্য সুরভ্রমণের মধ্যে শেষ হলো দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত চারদিন্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সবের। শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরলহরী আর্মি স্টেডিয়ামের খোলা ময়দানে গভীর রাতে এক ভিন্ন দ্যোতনার সৃষ্টি করেছিল। শিবকুমার শর্মার সন্তুরের সুরলহরী যেমন মাদকতা সৃষ্টি করেছিল, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি তেমনি দিয়েছে প্রভাতের নতুন আলো ফোটার আনন্দ। নৃত্যশিল্পী মাধবী মুডগাল ও আরশি মুডগালের নাচ মুগ্ধতা ছড়িয়েছে দর্শকদের মাঝে। কণ্ঠসংগীতে পণ্ডিত-বিদূষী—গিরিজা দেবী, অজয় চক্রবর্তী, পূর্বায়ন চ্যাটার্জিসহ নামকরা ওস্তাদরা মোহিবষ্ট করে তুলেছিলেন সকলকে। ধ্রুপদী সংগীত ও নৃত্যের প্রধান প্রধান শাখা ধ্রুপদ-ধামার, খেয়াল, কত্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি নৃত্যের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে দর্শক-শ্রোতাদের।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, আয়েত আলী খা, বিলায়েত্ খাঁর মতো জগত্খ্যাত সংগীতজ্ঞদের নাম জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। তারপরও বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রসার নানা কারণেই বেড়ে ওঠেনি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ধারাবাহিক এই উদ্যোগ বাংলাদেশের শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করবে নিঃসন্দেহে। সবার প্রত্যাশা, একদিন তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা বাংলাদেশের হারানো গৌরবকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠত করবে। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সবের এই সফল আয়োজন সেই স্বপ্নকে মূর্ত হয়ে ওঠার পথই দেখায়। সংগীতরসিকদের আগ্রহ বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রসার ঘটাবে, সংস্কৃতির শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে—এ প্রত্যাশা নিয়ে শেষ হলো পাঁচ দিনের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব। উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল এ আয়োজন। গত মঙ্গলবার ভোরে শেষ হলো সেই সুরের মেলা। এ উত্সবের উদ্যোক্তা বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু বললেন, ‘সংস্কৃতি ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য। তাহলে তারা বিপথে পা বাড়াবে না। যে জঙ্গি হামলা হয়েছে, যারা জঙ্গিবাদের পথে পা বাড়িয়েছে; তারা খুব অল্প। আর কেউ যাতে সেই ভুল পথে পা না বাড়ায়, সে ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।’ নৃত্য, কণ্ঠ ও যন্ত্রবাদন—সংগীতের প্রায় সব শাখারই জগদ্বিখ্যাত সব শিল্পী এসেছিলেন। এবারও উত্সব মুখর করে তুলেছিলেন বিদূষী গিরিজা দেবী, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা তার ছেলে রাহুল শর্মা, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। এসেছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাতি ওস্তাদ আশিষ খাঁ, ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করেন জয়পুর আত্রৌলির বিদূষী অশ্বিনী ভিদে ও মেওয়াতি ঘরানার পণ্ডিত অভয়ঙ্কর। পশ্চিমা ও কর্ণাটকী ঢংয়ের বেহালা বাজান ড. এল সুব্রহ্মণ্যন। উত্সবে প্রথমবারের মতো ‘ম্যান্ডোলিন’ ও বাঁশির যুগলবন্দি শোনান গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড নমিনি বাঁশিশিল্পী পণ্ডিত রনু মজুমদার ও ম্যান্ডোলিনের রূপকার প্রয়াত ইউ শ্রীনিবাসের ভাই ইউ রাজেশ। ওড়িশি নৃত্য নিয়ে এসেছিলেন বিদূষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগাল। আরও এসেছেন পণ্ডিত উল্লাস কশলকর, ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত কুশল দাস, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার, ড. প্রভা আত্রে, তবলিয়া অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বাংলাদেশের ১৬৫ জন শিল্পী এবার উত্সবে অংশগ্রহণ করেন। উত্সবের উদ্বোধনী পর্বে স্বনামধন্য নৃত্যশিক্ষক শর্মিলা বন্দোপাধ্যায়ের রচনা ও নির্দেশনায় নৃত্যনন্দন দলের প্রায় ষাটজন শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গান ও ভাঙ্গা গানে মণিপুরী, ভরতনাট্যম, ওডিশি ও কত্থক রীতির রূপায়ণ পরিবেশন করেন। প্রথিতযশা শিল্পী মুনমুন আহমদ তাঁর দল নিয়ে কত্থক পরিবেশন করেন উত্সবের চতুর্থ দিন। বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী প্রিয়াংকা গোপ এককভাবে খেয়াল এবং তাঁরই নির্দেশনায় দলগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা শাস্ত্রীয়সংগীত পরিবেশন করেন শেষ দিন। উত্সবের দ্বিতীয় দিন মোহাম্মদ শোয়েবের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে নিরীক্ষামূলক রাগসংগীত উপস্থাপন করেন। বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন দিনে দলীয়ভাবে সেতার, সরোদ ও তবলা পরিবেশন করেছেন উত্সবে।

View Full Article