বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬ বাংলাদেশে গিরিজা দেবীর শেষ গান
বাবার নেওটা ছিল চঞ্চলমতি ছোট্ট গিরিজা। জন্ম বেনারসে। বড় হওয়াও সেখানে। গঙ্গার ধারে ধুলোর মধ্যে খেলা করা, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, ঘোড়ায় চড়া, লড়াই করা—এই ছিল প্রাত্যহিক কাজ। বাবাও প্রশ্রয় দিতেন। চার বছর বয়সে একদিন বাবাই বসিয়ে দিলেন পণ্ডিত সূর্য প্রসাদ মিশ্রের সামনে। তারপর ইতিহাস…
ছোট্ট গিরিজাই এখন বেনারস ঘরানার জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী গিরিজা দেবী। তাঁকে ঠুমরির সম্রাজ্ঞী বলেন বিদগ্ধজনেরা। ছোটবেলার শিক্ষা বাদ দিলেও ৬৭ বছরের সংগীতজীবনে আরও গেয়েছেন অসংখ্য খেয়াল আর টপ্পা। গেয়েছেন কাজরি, চৈতি, হোলি গান। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সম্মাননা ও সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। পৃথিবীর সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি। গিরিজা দেবীর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র গিরিজা। লস অ্যাঞ্জেলেস ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি সেরা প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার পেয়েছে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের বাড়িতে গিরিজা দেবী এসেছিলেন গতকাল। সেখানেই কথা হলো তাঁর সঙ্গে। অনুযোগ করলেন, কেন তাঁকে হোটেলে রাখা হলো? এই বাড়িতে কেন নয়? হোটেলে থাকতে তাঁর ভালো লাগে না। আবুল খায়ের বললেন, এরপর থেকে এখানেই উঠবেন তিনি। খাবার টেবিলে বসে গিরিজা বললেন ইলিশ মাছের কথা। বাংলাদেশের ইলিশ তাঁর ভারি পছন্দ।
গিরিজা দেবী প্রথমে বললেন বাবা রামদেও রাইয়ের কথা। পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘সে সময় মেয়েরা গান শিখত না। তাও আবার গ্রামের মেয়ে। ভাবাই যেত না!’ তাই বাবা সমর্থন করলেও মা ও পরিবারের অন্যরা তাঁর গান গাওয়া পছন্দ করেননি। পরে অবশ্য মা-ই তাঁকে সাহায্য করেছেন।
প্রশ্ন ছিল, পারিবারিক কোনো আবহ না থাকলেও সংগীতে কীভাবে এলেন? গিরিজা বলেন, ‘এটা ভাগ্যের খেলা বলতে পারো। মীরা বাঈয়ের পরিবারেও কোনো সাধুসন্ত ছিল না। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ কীভাবে এত বড় বীর হলেন? দিল্লির রাজিয়া সুলতানা কীভাবে হলেন? পূর্বজন্মে হয়তো পুণ্য ছিল, তাই গানে আমার মন লেগে গেল।’
গুরু সূর্য প্রসাদের অধীনে সংগীতের কঠোর সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন গিরিজা দেবী। গুরুর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর কাছেই তালিম নেন তিনি। এরপর তাঁর গুরু শ্রীচাঁদ মিশ্র। চল্লিশ বছর একাধারে সংগীতের দীক্ষা নিয়ে তিনি আজকের গিরিজা দেবী।
পনেরো বছর বয়সে বিয়ে করেন ব্যবসায়ী শ্রী মধুসূদন জৈনকে। কবিতা ও সংগীতপ্রেমী স্বামীর সমর্থন না পেলে এত দূর আসা হতো না তাঁর। গিরিজা দেবী তাই স্মরণ করলেন তাঁর কথাও। বিয়ের পর গিরিজা দেখলেন, সাংসারিক দায়িত্বের চাপে রেওয়াজই করতে পারছেন না ঠিকমতো। মধুসূদন অভয় দিলেন, গিরিজাকে তাঁর মাসহ আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানেই দিনরাত এক করে নিরিবিলিতে রেওয়াজ চলত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসতেন মধুসূদন ও গুরু শ্রীচাঁদ। গিরিজা বলেন, ১৯৭৫ সালে মধুসূদনের মৃত্যুর পর ছয় মাস গান করতে পারেননি তিনি।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে এবার তৃতীয়বারের মতো এলেন তিনি। বাংলাদেশের আতিথেয়তার প্রশংসা করলেন এই শিল্পীও। আরও বললেন, এত বড় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব আর কোথাও হয় না। ভারত ও ভারতের বাইরের বড় বড় আয়োজনেও এক-দুই হাজারের বেশি শ্রোতা আসেন না। আর এখানে হাজার হাজার মানুষ! এঁদের সামনে গাওয়ার লোভ সামলানো দায়।
৮৭ বছরে এসে গিরিজা দেবী এবার একটু বিশ্রাম নিতে চান। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে এবারই শেষ পরিবেশনা তাঁর। এরপর আর মাত্র দুটি আসর, ভারতের রায়পুর ও পুনাতে গাইবেন তিনি। নাম কিংবা পয়সার জন্য আর গাইতে চান না এই কিংবদন্তি শিল্পী। তবে সংগীত থেমে থাকবে না। চলবে শেষনিশ্বাস পর্যন্ত। আবারও আসতে চান বাংলাদেশে। তবে গাইতে নয়, এখানকার বাচ্চাদের সংগীত শেখাতে। বাকি জীবন গানই শেখাতে চান তিনি।