বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬ ভোর ফুটেছিল বাঁশরিয়ার লোকজ ধুনে
যাঁর বাঁশির লোকজ ধুনে গতকাল ভোর ফুটেছিল, একটি কালো গাড়িতে করে ফিরছিলেন তিনি। পেছনে একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, তারও পেছনে একটি সাদা অ্যাম্বুলেন্স। মানুষের অরণ্য থেকে বাঁশরিয়া ফিরছিলেন নিঃসঙ্গতায়। তাঁকে বহন করা গাড়িটিকে থমকে যেতে হয় কয়েক মুহূর্ত। হাজারো অনুরাগী সরে সরে দাঁড়িয়ে গাড়িটিকে এগিয়ে যাওয়ার জায়গা করে দেন। কেউ কেউ কাচের ওপারে তাঁর অবয়বের দিকে দুই হাত জোড় করে শ্রদ্ধা জানান।
গতকাল মঙ্গলবার ভোর চারটা বাজার খানিক আগে মঞ্চে উঠেছিলেন বাঁশির জাদুকর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তাঁর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের সে কী উল্লাস! অন্ধকার মঞ্চেই হঠাৎ বেজে উঠেছিল একচিলতে সুর। যেন অপেক্ষমাণ ভক্তদের তিনি জানান দিলেন, আর অপেক্ষা করতে হবে না। বাতি জ্বলতেই করতালি দিয়ে প্রিয় বাঁশরিয়াকে অভিবাদন জানালেন ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে হাজির হওয়া হাজার হাজার মানুষ। নিজের সাদাকালো অতীতের দিকে চাইলে হয়তো দেখতে পেতেন, চারপাশে উন্মাদ হর্ষধনি। দড়ি দিয়ে ঘেরা একটি মঞ্চে কুস্তি লড়ছেন তিনি। বাবা কুস্তিগির ছিলেন তাঁর। চেয়েছিলেন সন্তানও তা-ই হোক। বাবার ইচ্ছায় কিছুদিন প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। কিন্তু চুপিচুপি গান শিখছিলেন এক প্রতিবেশীর কাছে। পরে গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন পণ্ডিত রাজারাম, বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবীর মতো অনেক গুণী মানুষকে। শিখেছেন বাঁশি বাজানো। চুপিচুপি যে প্রেমে তিনি সেদিন মজেছিলেন, সেটিই তাঁকে দিয়েছে অমরত্ব। জীবদ্দশায় কজন মানুষের ভাগ্যে জোটে এমন অফুরান ভালোবাসা!
বাঁশিতে রাগ প্রভাতি ও রাগ জৈৎ বাজিয়ে শোনানোর আগে চৌরাসিয়া বলেছিলেন, ‘বহু দেশে বাঁশি বাজাতে গিয়েছি। বাঁশি শুনতে আসা এত মানুষ আমি কখনো দেখিনি।’ কপালে সিঁদুরের তিলক, পাঞ্জাবির ওপরে কোটি। সেটির পকেটেও একটি ছোট বাঁশের বাঁশি। তার থেকেও বেশ বড়টি হাতে, যেটিতে এক্ষুনি ঠোঁট রাখবেন তিনি। মাঠ ও গ্যালারির প্রতিটি চোখ মঞ্চে, সজাগ কানগুলো শুনছিল তাঁর কথা। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তিনি বাজালেন। বনানীর আকাশে তখন আর কোনো শব্দ ছিল না। সঙ্গে তবলায় তাল দেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, পাখওয়াজে পণ্ডিত ভবানী শঙ্কর। আর তাঁর সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে সহযোগিতা করেছেন দেবপ্রিয় রণদ্বীপ ও বিবেক সোনার এবং তানপুরায় অভিজিৎ কুণ্ডু। সেই সুরে মন রাখলে, কান পাতলে ভুলে যেতে হয় স্থান, কাল, সময়—এমনকি নিজের অস্তিত্বকে।
বাঁশি পরিবেশন করে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিরাপত্তাকর্মীদের তৈরি করা দূরত্ব বজায় রেখে এক ভক্ত জানতে চাইলেন, ‘আবার আসবেন তো?’
ইশারায় ইতিবাচক আশ্বাস দিলেন ৭৮ বছর বয়সী বিদগ্ধ বাঁশরিয়া।