বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আত্মসুদ্ধির মাহেন্দ্রক্ষণ
শেষ রাতের তারাগুলো তখনও ম্লান হয়নি। হেমন্তের পূর্ব আকাশে হালকা আভায় জানান দিচ্ছে রবির আগমনী বার্তা। ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম রসবোধসম্পন্ন সঙ্গীতশ্রোতার উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভর্তি। হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে বাঁশিতে বিদায়ের কান্নার সুর যেন অনন্ত শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। আনন্দের সুরের মধ্যে করুণার কোমল নিখাঁদ নতুন দিনের আহ্বান জানাচ্ছে। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি থেকে ভেসে আসছে প্রভাতী রাগের সুর। মুহূর্তের মধ্যে যেন পুরো পরিবেশটা হয়ে উঠল মহাযজ্ঞের তীর্থ ক্ষেত্র। শ্রোতাকুল নির্লিপ্তে, নীরবে সুরের মায়াজালে যেন সপে দিলেন নিজেদের। এরপর রাগ জৈৎ শোনান রূপক ও ত্রিতালে। সবশেষে ছিল লোকগানের ধুন পরিবেশনা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হরিপ্রসাদ থরথর কাঁপতে থাকা হাতে বাঁশি তুলে নেন উৎসবের শেষ সুরধ্বনি শোনাতে। সোমবার রাতভর বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনার পর মঞ্চে আসেন প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। হাজার হাজার দর্শকশ্রোতার করতালির মধ্যদিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেন কিংবদন্তি এই সাধক শিল্পী। তাঁর সঙ্গে তবলায় তাল দেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, পাখাওয়াজে প-িত ভবানী শঙ্কর, বাঁশিতে দেবপ্রিয় রণদ্বীপ ও বিবেক সোনার এবং তানপুরায় ছিলেন অভিজিৎ কু-ু। এভবেই বাঁশির সুরে পর্দা নামল উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আসরের।
রাজধানীর বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ছিল শ্রতামুখর বিনিদ্ররজনী। সুরের স্রোতধারায় স্নাত হলো সঙ্গীত পিয়াসীরা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মোহতায় আত্মসুদ্ধির এক অপূর্ব সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশের শ্রোতা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শুরু হওয়া সুরের যাত্রা শেষ হলো ভোরে। দেশ-বিদেশের নামকরা শিল্পীদের কণ্ঠের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধুর্যে সিক্ত হলো হাজারও শ্রোতার অন্তরাত্মা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠ, যন্ত্র আর নৃত্যের সম্মিলনে কেটেছে প্রতিটি বিভাবরী।
এ উৎসব শুধুমাত্র গান শোনার জন্য নয়, আত্মসুদ্ধির এক নির্মল মাহেন্দ্রক্ষণ। বছরে একবার আসে আবার চলেও যায়। রেখে যায় শুচি শুভ্রতার চেতনা। শেখায় প্রকৃত মানুষ হতে। সবটুকু সম্ভব না হলেও কিঞ্চিত আভা তো রেখে যায় আগামীর জন্য।
পঞ্চমবারের মতো উৎসবের আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতির প্রতি।
পঞ্চরজনীর শাস্ত্রীয় গানের উৎসবের সূচনাসন্ধ্যা ছিল গত ২৪ নবেম্বর বৃহস্পতিবার। শুরুতেই ছিল ‘রবি করোজ্জ্বল’ শিরোনামের শাস্ত্রীয় নৃত্য। শিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নৃত্য পরিবেশন করে তার সংগঠন নৃত্যানন্দনের শিল্পীরা। পরে শিল্পী প্রবীণ গোডখিন্ডির বাঁশির সঙ্গে যুগলবন্দীতে ছিল রাতিশ তাগড়ের বেহালাবাদন। তবলায় সঙ্গত করেন রামদাস পালসুল। এরপর ছিল উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্যবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেনÑ বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতার পর খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন ৮৭ বছর বয়সী বিদুষী গিরিজা দেবী। রাগ ‘যোগকোষ’ দিয়ে শুরু তার পরিবেশনা। পরে রাগ মিশ্র খাম্বাসে ঠুমরি, একটু থেমে টপ্পার পর আরেকটি রাগ পরিবেশনার মধ্যদিয়ে শেষ হয় তার পরিবেশনা। শিল্পীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন গোপাল মিশ্র ও সারাঙ্গিতে সঙ্গত করেন মুরাদ আলি খান। এরপর সরোদ পরিবেশন করেন ওস্তাদ আশিষ খাঁ। তিনি পরিবেশন করেন রাগ দরবারি কানাড়া, চন্দ্রবদন ও মিশ্র ভৈরবী। খ্যাতিমান তবলাশিল্পী প-িত বিক্রম ঘোষও সমানতালে দেখিয়েছেন তার হাতের জাদু। যুগলবন্দী খেয়াল ‘জসরঙ্গি’ পরিবেশন করেন শিল্পী বিদুষী অশি^নী ভিদে দেশপা-ে ও প-িত সঞ্জীব অভ্যাঙ্কর। তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার। প্রথম দিনের আয়োজন শেষ হয় ড. এল সুব্রহ্ম্যণনের বেহালাবাদনের মধ্য দিয়ে। তিনি পরিবেশন করেন কৃতি, মোহনাম ও নিজের সৃষ্টি রাগ ‘ছন্দপ্রিয়া’। তবলায় সঙ্গত করেন প-িত তন্ময় বসু।
দ্বিতীয় রাতের প্রথম পরিবেশনা ছিল বিদুষী মাধবী ও তার ভ্রাতুষ্পুত্রী আরুশি মুদগালের নৃত্য। মুগ্ধ চোখে দর্শক ওড়িশি নাচই দেখছিল। পরের পরিবেশনা ছিল বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীদের তবলাবাদন। প-িত অরুণ ভাদুড়ির শিষ্য প্রিয়াংকা গোপ পরিবেশন করেন রাগ বাগেশ্রীতে রয়াল ও কৌশিকধ্বনিতে ঠুমরি। দ্বিতীয় রজনীর অন্যতম আকর্ষণ রাহুল শর্মার সন্তুর পরিবেশনা। রাগ গাবতী দিয়ে তার পরিবেশনা শুরু করেন। সঙ্গে তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ শোয়েব ও অন্যরা। সেতারে সুর ছড়ান পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়। প-িত উলহাস কশলকারের খেয়ালের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন সুরেশ তালওয়ালকার। দ্বিতীয রাতের আরেক আকর্ষণ ছিল প-িত রনু মজুমদারের বাঁশি ও ইউ রাজেশের ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দী পরিবেশনা। এভাবে ম্যান্ডোলিন আর বাঁশির মধুর পরিবেশনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় দ্বিতীয় রজনীর পরিবেশনা।
শনিবার ছিল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের তৃতীয় রজনী। এদিনের পরিবেশনার সূচনা হয় সরোদের সুরে। বেজেছে বাঁশরিয়ার বাঁশির সুর, শোনা গেছে কণ্ঠশিল্পীর খেয়াল, তবলার বোল এবং ধ্রুপদ ও খেয়ালের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবের সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক। বাংলাদেশে আর্মি স্টেডিয়াসে চলমান উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে।
বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের ৭ নবীন শিক্ষার্থী শিল্পীর সরোদ বাদন দিয়ে শুরু হয় তৃতীয় দিনের আয়োজন। বাঁশিতে রাগ পূরবী কল্যাণী পরিবেশন করেন কর্ণাটকি ঘরানার বংশিবাদক শিল্পী শশাঙ্ক সুব্রহ্ম্যণন। সঙ্গে মৃদঙ্গে সঙ্গত করেন পারুপল্লী ফাল্গুন ও তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। বাঁশির বাদন থামতেই ভেসে আসে শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করা খেয়ালের সুর। মঞ্চে আসেন ভারতীয় ধ্রুপদি সঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী ড. প্রভা আত্রে। কিরানা ঘরানার অগ্রজ এ শিল্পী খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা, গজল ও নাট্যসঙ্গীতে সমান পারঙ্গম। তবলায় সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার। এরপর মঞ্চে আসেন ফরুখাবাদ ঘরানার অন্যতম তবলিয়া প-িত অনিন্দ্য বঙ্গোপাধ্যায়। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গ করেন অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়। ধ্রুপদ পরিবেশন করেন প-িত উদয় ভাওয়ালকর। এ পরিবেশনায় পাখোয়াজে সঙ্গত করেন প্রতাপ আওয়াদ। সেতারে মিষ্টি সুর ছড়িয়েছেন প-িত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সেতারের সুর মূর্র্ছনায় তবলার বোলে ভিন্নমাত্রা যোগ করেন পরিমল চক্রবর্তী। এদিন ভোররাতে মঞ্চে আসেন উৎসবের তৃতীয় রাতের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খান। বিলম্বিত আলাপের আবেগময়তা, বিস্তারের গভীরতা ও তানকারীর ব্যতিক্রমী পরিবেশনার স্বাদ মেলে তার পরিবেশনায়। এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তৃতীয় রাতের আয়োজন শেষ হয়।
রাধা প্রতি সন্ধ্যায় যমুনা নদী থেকে ছোট কলসিতে করে পানি আনতে যায়। দুষ্ট কৃষ্ণ ঢিল মেরে কলসির সব পানি ফেলে দেয়। কৃষ্ণের কাছে রাধা জানতে চায়, কেন সে এমন কাজ করল? কত্থকের লক্ষেèৗ ঘরানার জনক বিন্দাদিন মহারাজ ঘটনাটি নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত ঠুমরি ‘মোরি গগরিয়া কাহেকো ফোড়ি রে শ্যাম’। উৎসবের চতুর্থ রাতে প্রথম আসরে বাংলাদেশের শিল্পী মুনমুন আহমেদ এই গানের সঙ্গে কত্থক নাচে দেখালেন কৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিমান। প-িত বিরজু মহারাজের এই শিষ্য দেখিয়ে দিলেন, কৃষ্ণ সে অভিমান ভাঙল কী করে। সঙ্গে ছিল তার দল রেওয়াজ। পরের পরিবেশনা ছিল তরুণ তবলাশিল্পী নীলেশ রণদেবের। তিনি তবলায় তিনতাল বাজান। হারমোনিয়ামে ছিলেন মিলিন্দ কুলকার্নি। এরপর মঞ্চে আসেন জয়তীর্থ মেউন্ডি। কিরানা ঘরানার এই শিল্পী রাগ শুদ্ধ কল্যাণ, আদানা ও নাট্যগীতে খেয়াল পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি। এরপর ছিল প-িত যোগেশ শামসি ও প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তবলার যুগলবন্দী। ভীষণ উপভোগ্য ছিল তাদের পরিবেশনা। চতুর্থ রাতের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কর্ণাটকি কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী দুই বোন রঞ্জনি বালসুব্রহ্ম্যণন ও গায়ত্রী বালসুব্রহ্ম্যণনের যুগল পরিবেশনা। শিল্পীদ্বয়ের স্বতন্ত্র্য গায়কী ছুঁয়ে যায় সঙ্গীতপ্রেমীদের মন। সরোদ নিয়ে মঞ্চে আসেন প-িত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। স্বনামধন্য সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের কৌশলগত দক্ষতা এবং ধ্রুপদ, তন্ত্রকারী ও বিভিন্ন গায়কীর উপাদানে সমুজ্জ্বল ছিল পরিবেশনাটি। চতুর্থ রজনীর শেষ পরিবেশনা ছিল এই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আসরের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী প-িত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল।
রাগ ভূপালির আশ্রয়ে দলীয় কণ্ঠসঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় সোমবার সমাপনী রাতের পরিবেশনা। এই সম্মেলক কণ্ঠসঙ্গীত উপস্থাপন করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। দেশের শিল্পীদের দুইটি পরিবেশনার পর ছিল উৎসবের সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।
সমপানী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চে আসেন এবারের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ প-িত শিব কুমার শর্মা। টানা এক ঘণ্টা তিনি সন্তুর পরিবেশনা দিয়ে মাতিয়ে রাখেন। খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন কুমার মারদুর। প-িত কুশল দাসের পর খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতি অঙ্কালিকার।
সবশেষে বাঁশিতে সুর তোলেন প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তার পরিবেশনার মধ্যদিয়ে শেষ হয় পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ২০১৬। শেষ পরিবেশনার পর তার হাতে উৎসব সম্মাননা তুলে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।