Menu

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের অদ্যোপান্ত সুরের মায়াজালে বিনিদ্র রাতগুলো

সঙ্গীতে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ বলে কিছু নেই। সেটা থাকলে পৃথিবী থেকে অনেক আগেই বিদায় নিত অনেক ধারার সঙ্গীত। কিন্তু তেমনটা হয়নি। কারণ সব সঙ্গীতই সাতটি স্বরের খেলা। তবে পৃথিবীর সব জাতিতেই এমন কিছু সঙ্গীত রয়েছে যা সঙ্গীতের মৌলিক ধারায় প্রবাহিত। আমাদের উপমহাদেশের সঙ্গীতের মূলেরও একটা স্বকীয়তা আছে। এটি পৃথিবীর অন্য ধারার ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীত থেকে আমাদের একেবারেই আলাদা করেছে তার নিজস্ব ঢং, পরিবেশনা এবং বৈচিত্র্যের কারণে। এই সঙ্গীত মূলত ধ্রুপদী সঙ্গীত নামে পরিচিত। যদিও এর নানা বিন্যাস শাখা-প্রশাখা আছে। তবে একটি জায়গায় এই সঙ্গীত এক যে, বিভিন্ন রাগ-রাগিণী সন্নিবেশিত হওয়ায় এটি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। মন-প্রাণে এক ধরনের স্বর্গীয় অনুভূতিতে ছুঁয়ে দেয়। সেই সঙ্গীতেরই সবচেয়ে বড় আসরটি আবার বসেছিল ঢাকায়। সুরের মায়াজালে পাঁচটি বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব ২০১৬ সফলভাবে শেষ হয়েছে। শেষ হলেও এখনও রয়ে গেছে তার রেশ। শহরজুড়ে এখনও সবার মুখে মুখে ফিরছে এবারের উৎসবকে নিয়ে নানা কথা।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজনে পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত এবারের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আসরটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। উৎসবস্থল অন্যবারের মতো এবারও বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম। আসরের প্রথম রাত ছিল ২৪ নভেম্বর গত বৃহস্পতিবার। চলছে ২৮ নভেম্বর সোমবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয়ে উৎসব চলছে ভোররাত ৫টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর শেষ দিন সমাপনী আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

এবারের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ কে ছিলেন তা নিয়ে একটি প্রশ্ন করাই যেতে পারে। তার উত্তরে বলা যায় উৎসবের প্রত্যেক দিনই কেনো না কেনো চমক ছিল। তবে সাধারণ মানুষসহ সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা এবং বিদুষী গিরিজা দেবী। এদের মধ্যে প্রথম দুই জনের পরিবেশনা ছিল উৎসবের শেষ রাত গত সোমবার। আর বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা ছিল উৎসবের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার। তাদের পাশাপাশি প্রতি রাতেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপালদের পরিবেশনা মুগ্ধ করেছে সবাইকে। এবারের উৎসবের আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে আয়োজনের বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা আনার চেষ্টা। শাস্ত্রীয় নৃত্য, কণ্ঠের খেলায় কখনও খেয়াল, কখনও ধ্রুপদী, যন্ত্রসঙ্গীতে সেতার, সরোদ, সন্তুর, ম্যান্ডোলিন, বেহালা, কখনও বা বাঁশি, তবলার আলাদা আলাদাভাবে দীর্ঘ সময়ের পরিবেশনা শ্রোতারা উপভোগ করছেন। উৎসবস্থলে প্রদর্শিত হয়েছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন যন্ত্র। সুরের ভেলায় ভাসতে ভাসতেই শ্রোতারা ঘুরে আসতে পেরেছেন ঢাকা নিয়ে বিশেষ স্থাপত্য প্রদর্শনী ‘আগামীর ঢাকা’ থেকে। যেখানে বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরে আধুনিক এক ঢাকার চেহারা ফুটে উঠেছে। পুরনো এবং নতুন ঢাকা পুরোটাই প্রদর্শন করা হয়েছে একেবারেই নতুন আঙ্গিকে। আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে বাইরের শিল্পীদের পাশাপাশি আলো ছড়িয়েছেন দেশের শিল্পীরাও। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে দেশে একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে তাদের পরিবেশনাও ছিল উৎসবে।

উৎসবের প্রথম দিন গত বৃহস্পতিবারের প্রধান আকর্ষণে ছিলেন বিদুষী গিরিজা দেবী। ঢাকায় এটি ছিল তার শেষ পরিবেশনা। এদিন প্রথমেই তিনি পরিবেশন করেন রাগ যোগকোষ। এরপর তার কণ্ঠে শোনা যায় রাগমিশ্র খাম্বাসে ঠুমরি। একটু থেমে টপ্পার পর আরেকটি রাগ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার পরিবেশনা। এদিন আরও ছিল ড. এল সুব্রক্ষ্ম্যণনের বেহালা, ওস্তাদ আশিষ খানের সরোদ আর প্রবীণ গোদখিণ্ডির বাঁশি আর রাতিশ তাগড়ের বেহালার সুর। নানা আঙ্গিকের পরিবেশনায় প্রথম রাতেই রাঙিয়ে ওঠে আসর।

দ্বিতীয় রাতের শেষ আকর্ষণ ছিল পণ্ডিত রনু মজুমদারের বাঁশি ও ইউ রাজেশের ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি পরিবেশনা। এদিন ওডিশি নৃত্যের ছন্দে আলো ছড়িয়েছেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগাল। দেশের শিল্পী প্রিয়াংকা গোপ পরিবেশন করেন খেয়াল। মুগ্ধ হয়ে শ্রোতারা শুনেছেন রাহুল শর্মার সন্তুর। সেতার পরিবেশন করেন পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। গত বুধবার উৎসবের তৃতীয় রজনীতে খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন ড. প্রভা আত্রে। তিনি শুরুতেই পরিবেশন করেন রাগ শ্যামকল্যাণ। এরপর নিজের সৃষ্টি করা রাগ মধুরোকোষে খেয়াল পরিবেশন করে মুগ্ধতা ছড়ান। এরপর রাগ কানাড়ায় দাদরা নায়োকি পরিবেশন করেন। সবশেষে রাগ বৈরবীতে ভজন পরিবেশন করে শেষ করেন তার পরিবেশনা। উৎসবের তৃতীয় রজনীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল ওস্তাদ রশিদ খানের খেয়াল পরিবেশনা। বাঁশির সুরে মনে-প্রাণে দোলা দিয়েছেন শশাঙ্ক সুব্রক্ষ্ম্যণন। তবলা বোলে মাত করেন পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সেতারের তারে তারে সুরের মূর্ছনা ঝরিয়েছেন পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার শুনিয়েছেন ধ্রুপদ।

চতুর্থ রাতে কর্ণাটকী কণ্ঠসঙ্গীতের যুগলবন্দিতে মাত করেছেন রঞ্জনি বালাসুব্রক্ষ্ম্যণন ও গায়ত্রী বালাসুব্রক্ষ্ম্যণন। ছিল পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল পরিবেশনা। যোগেশ শামসি ও পণ্ডিত শুভঙ্করের তবলার যুগলবন্দি ছিল এক কথায় অপূর্ব। খেয়াল পরিবেশন করেন জয়তীর্থ মেউন্ডি। সরোদ পরিবেশন করেন পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার। তবলা পরিবেশন করেন নীলেশ রণদেব। এদিন আয়োজনের শুরুতেই নৃত্য পরিবেশন করেন মুনমুন আহমেদ ও তার দল ‘রেওয়াজ’।

উৎসবের সমাপনী দিন অর্থাৎ গত সোমবার প্রথমেই সন্তুরের সুরমাধুর্যে মাত করেছেন পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা। সান্ধ্যকালীন রাগ যোগের আশ্রয়ে পরিবেশনা দিয়ে শুরু করেন। আলাপ দিয়ে শুরু করে রূপক তাল পেরিয়ে পৌঁছে যান তিন তালে। সবশেষে পাহাড়িয়া ধুন বাজিয়ে মাত করেন।

পঞ্চম ও সমাপনী দিনের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার। তার বাদন শুনতে শেষরাতে আর্মি স্টেডিয়ামে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। মন্ত্রমুগ্ধ করা বাঁশিতে ভরিয়ে দেন সবার মন। তিনি বাঁশিতে রাগ প্রভাতী ও রাগ জৈৎ বাজিয়ে শোনান। তারপর ফোক ধুনে কীর্তন পরিবেশন করে শেষ করেন তার পরিবেশনা। সঙ্গে তবলায় তাল দেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। পাখাওয়াজে ছিলেন পণ্ডিত ভবানী শঙ্কর। চৌরাশিয়ার বাঁশির সুরে সুরেই শেষ হয় পাঁচদিনের বেঙ্গল উচ্চঙ্গ সঙ্গীত ২০১৬ এর আসর।

এবারের আয়োজনে নিরাপত্তা ছিল চোখে পড়ার মতো। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। হলি আর্টিসানের ঘটনার পর এই ধরনের একটি আয়োজনকে সফল করটাকে অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এবং সেটি সফল হয়েছে। এজন্য আয়োজকদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান হয় প্রধানমন্ত্রীকে। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের। তবে অতিরিক্ত কড়াকড়ি কারো কারো জন্য ঝক্কি-ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পার্কিংয়ের সুবিধা না থাকায় ঝামেলা পোহাতে হয় মিডিয়া কর্মীদেরকেও। তবে সবকিছুর পরে সফল একটি আয়োজন হয়েছে এটি এই উৎসবের স্বার্থকতা।

 

View Full Article