বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব-২০১৬ শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর লহরিতে মোহাবিষ্ট হাজারো দর্শক
হাসনাত শাহীন
বার মাসের তের পার্বণের এই দেশে এখন হেমন্ত ঋতু। হেমন্ত মানে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের নতুন চালের মৌ-মৌ গন্ধে প্রকৃতিতে এখন বিরাজ করছে এই হেমন্তের শেষ মাস অগ্রহায়ণ। হালকা শীতের সঙ্গে দিনভর সূর্যের তেজদিপ্ত আলোর পরিবর্তে সূর্যের প্রায় তেজহীন মোলায়েম আলোর পরশে হালকা কুয়াশার লুকোচুরি। দিনভর সূর্য আর কুয়াশার এমনই লুকোচুরির মধ্য দিয়ে প্রকৃতিজুড়ে নেমে আসে সন্ধ্যা-রাত। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুমের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ। কিন্তু রাজধানী ঢাকার এমনই সন্ধ্যা মানেই এখন নতুন আনন্দ-নতুন ছন্দে-হিন্দোলে ভাসার অপেক্ষার প্রহর গুনে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যানজটের তীব্রতা পেরিয়ে কাজের ক্লান্তি ভুলে ছুটে আসে আর্মি স্টেডিয়ামে। গতকালও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কেননা সেখানে চলছে পঞ্চমবারের মতো ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব-২০১৬’। গতকাল দিন শেষে হালকা শীতের সন্ধ্যা একটু ঘনিয়ে এলেই বিগত দু’দিনের মতোই শুরু হয় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের আয়োজন। মূহূর্তেই প্রচন্ড যানজট ঠেলে আসা কয়েক হাজার সংগীতপ্রিয় মানুষ ভুলে গেল তার ভোগান্তির কথা।
ধ্রুপদ সুরের ঝর্ণাধারা-মানুষকে দেয় অনন্তলোকের সন্ধান। যেখানে প্রেম আর পূর্ণতা অনুপম দ্যোতনা হয়ে এক সঙ্গে ধরা দেয়। শাস্ত্রীয় সংগীতের এমন অমিয় হিরন্ময় সুরধারা উপমহাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব চরাচরেও তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এই পাললিক জনপদ ধ্রুপদ সুরের প্রধানতম উর্বর ভূমি। এ মাটিতে বেড়ে ওঠা সুর সাধকরা তাদের নৃত্য আর গায়কীর অনন্যতায় রাগ-রাগিনীতে সে সুধাই বিলিয়ে দিয়েছেন কখনো কণ্ঠে আবার কখনো যন্ত্রে সুর-লহরা সৃষ্টি করে। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের এ তৃতীয় দিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে পরদিন ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত একটানা চলে উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের দিকপাল শিল্পীদের সঙ্গে বাংলাদেশি শিল্পীদের কণ্ঠে সুর-লহরী আর হৃদয়ে সি্নগ্ধতা ছড়ানো সরোদ-বেহালা-তবলার-আর ওস্তাদ রাশিদ খানের অতিমানবীয় কণ্ঠের মধুময় সুর-ধ্বনি। ছিল ‘শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন’ এর কর্ণাটকি বাঁশিতে সৃষ্ট মাতাল করা সুরধ্বনি। হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক মোহাবিষ্ট ছিলেন এই শিল্পীর পরিবেশনাসহ আর সবার নিজ নিজ পরিবেশনা উপভোগের সময়। শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর-লহরীর টানে এদিনও আর্মি স্টেডিয়ামে সন্ধ্যা-রাত-ভোর সুরের নেশায় মগ্ন ছিলেন হাজার হাজার সংগীত পিয়াসী মানুষ। কেটেছে হাজার শ্রোতার নির্ঘুম রাত আর শিশিরের সঙ্গে কেটেছে শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর-ছন্দের অনবদ্য লুকোচুরি। শাস্ত্রীয় সংগীতের নির্যাস উপভোগ করে তবেই ফিরেছেন বাড়ি।
প্রথম দুই দিনের তুলনায় গতকাল স্টেডিয়ামে শ্রোতা সমাগম কিছুটা কমই ছিল। বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতের মতো নয় শনিবারের রাত। রাত পোহালেই সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস-রোববার। সেই প্রভাবই পড়েছে কিছুটা স্টেডিয়ামে গতকালের আয়োজনে। শ্রোতা সংখ্যা কমেছে অনেক। স্টেডিয়ামে গ্যালারি ছিল প্রায় শূন্য, অর্ধেক খালি ছিল মঞ্চের সামনে সামিয়ানা টাঙানো আসনগুলো। তবে, খাবারের স্টলের দিকে প্রতিদিনের মতো গতকালও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের দেখে মনে হচ্ছে এখানে শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর-সুধায় ভেসে আসেনি, এসেছে উৎসবের অংশীদার হতে। আর মাঠের এক প্রান্তে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যে প্রদর্শনী, সেখানেও ছিল উৎসুক দর্শনার্থীদের ভিড়। শ্রোতার ভিড় কম থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কম ছিল ভোগান্তি। অন্য দিনের মতো লম্বা সারিতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে হয়নি শ্রোতাদের। তাছাড়া শৌচাগার ব্যবহারের জন্যও ছিল না দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ভোগান্তি।
দেশের বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গ করা এবারের এ উৎসবের গতকাল তৃতীয় দিনের এ আয়োজনের শুরু হয় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের ৭ নবীন শিক্ষার্থীর পরিবেশনায় সরোদের সুরে-সুরে। দেশের শিল্পীদের এ সরোদের সুরের তালে তালে তবলায় উঠেছিল তুমুল বোল। এই সরোদ বাদনে অংশ নেন কামাল জহির শামীম, খন্দকার শামছুজোহা, ইলিয়াস খান, ইলহাম ফুলযুরী খান, ইশরা ফুলযুরী খান, শরীফ মুহাম্মাদ আরিফিন রনি ও আল জোনায়েদ দিদার। সম্মেলক এ পরিবেশনায় উপস্থাপিত হয় রাগ কাফি। শিক্ষার্থীদের এই পরিবেশনা দেখে মোটেও মনে হয়নি তারা শিখছে এখনও। বড়দের মতোই বাজিয়েছে তারা ওস্তাদি ঢংয়ে। তাদের বাদন শেষে মঞ্চে আসেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষক পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। তিনি শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা সম্পর্কে বলেন, ‘এই বাদকদলের জন্য আপনারা দোয়া করবেন। সাত মাস ধরে আমি তাদের শিখাচ্ছি। আশা করি, তাদের মধ্য থেকে এক-দুই জন বড় বাদক আমি তৈরি করতে পারবো।’
সরোদ বাদন শেষে কর্ণাটকি বাঁশি নিয়ে মঞ্চে আসেন শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন। বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় সঙ্গীত উৎসবে অংশ নিয়েছেন এ শিল্পী। ২০০৯ সালে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হন তিনি। তার সঙ্গে মৃদঙ্গমে সঙ্গত করেন পারুপল্লী ফাল্গুন ও তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। বংশীবাদন থামতেই শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে খেয়ালের সুর। মঞ্চে আসেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী ড. প্রভা আত্রে। কিরানা ঘরনার অগ্রজ এ শিল্পী খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা, গজল ও নাট্যসঙ্গীতে সমান পারঙ্গম। তার ঝুলিতে রয়েছে নানা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তার পরিবেশনায় তবলায় সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে মঞ্চে আসেন ফরুখাবাদ ঘরনার অন্যতম তবলাবাদক পন্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়। এরপরেই মঞ্চে ধ্রুপদ পরিবেশন করেন পন্ডিত উদয় ভাওয়ালকার। কুমার গান্ধর্ব সম্মাননাপ্রাপ্ত শিল্পী তিনি। এ পরিবেশনায় পাখোয়াজে সঙ্গত করেন প্রতাপ আওয়াদ। পন্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় মিষ্টি সুরের লহরী ছড়িয়ে দেন সেতারে। তার সঙ্গে তবলায় ঝড় তুলেন পরিমল চক্রবর্তী। সঞ্জয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক। পরিমল-ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অতিথি শিক্ষক। পরিমল চক্রবর্তীর এই তবলার বোলের মধুরধ্বনিতে-ধ্বনিতে রাত প্রায় শেষের দিকে। মঞ্চে আসেন গত রাতের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খান। তিনি ভারতের অন্যতম খেয়াল শিল্পী। শুধু তার গান শোনার আগ্রহে অনেকেই এসেছিলেন উৎসবে। এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পন্ডিত শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। এ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তৃতীয় রাতের আয়োজন শেষ হয়।
প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হবে উৎসব। উৎসবের চতুর্থ দিনের আয়োজনের শুরুতেই কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবে মুনমুন আহমেদ ও তার দল রেওয়াজ। তবলায় বোল তুলবেন নীলেশ রণদেব। খেয়াল পরিবেশন করবেন কিরানা ঘরানার শিল্পী জয়তীর্থ মেউন্ডি। তবলায় যুগলবন্দি পরিবেশন করবেন পন্ডিত যোগেশ শামসি ও পন্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যুগলবন্দি কর্ণাটকী সংগীত পরিবেশন করবেন শিল্পী বেহালাবাদক রঞ্জনী ও গায়ত্রী। পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার পরিবেশন করবেন সরোদ। আজকের অনুষ্ঠান শেষ হবে পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।