Menu

বেহালার সুরে মহাযজ্ঞ শুরু

thumbnail

ভারতের বেহালাজগতে তাঁকে বলা হয় মুকুটহীন সম্রাট। পশ্চিমা দুনিয়ার সেরা বেহালাবাদক নিকোলো পাগানিনির সঙ্গে তাঁকে তুলনা করে বলা হয় ‘ভারতের বেহালা ঈশ্বর’। তিনি খ্যাতিমান বেহালাশিল্পী ড. এল সুব্রামানিয়াম। উৎসবের শুরুতেই বেহালার সুরে আসর জমিয়ে তুলেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। তাঁর একেকটি পরিবেশনা সুরপিয়াসীদের হৃদয়ে যে রেশ ছড়িয়ে দেয় তার অনুরণন চলে অনেকটা সময় ধরে। কখনো দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের লয়ে, কখনো বা পশ্চিমা ধাঁচের ধ্রুপদি সুরে বেহালা বাজিয়ে উৎসবস্থলজুড়ে তিনি বয়ে দেন সুরের ঝংকার।

ড. এল সুব্রামানিয়ামের বেহালার সুরেই গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে শেখ কামাল আবাহনী মাঠে পর্দা উঠেছে বেঙ্গল আয়োজিত পঞ্চরজনীর উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে। স্কয়ার নিবেদিত এই উৎসব আয়োজনে সহযোগিতায় রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক।

পৌষের সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে বইছিল মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া। রাত যত বাড়ছিল ততই যেন জেঁকে বসছিল শীত। কিন্তু সেই শীত ও কুয়াশা ভেদ করে রাতভর বইছিল সুরের উষ্ণতা। বেহালা, সরোদ, সেতার, কণ্ঠমাধুর্য, বাঁশির মোহিনী সুরের সঙ্গে ছিল কাজাখস্তানের একঝাঁক শিল্পীর অর্কেস্ট্রার জাদু। গতকাল সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত আবাহনী মাঠে উপস্থিত শ্রোতারা তন্ময় হয়ে উপভোগ করল সুরের সেই কারিশমা।

পাঁচ বছর ধরে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজন হওয়া উৎসবটি ষষ্ঠ বছরে স্থানান্তরিত হলো ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে। ছন্দপতনের সব আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে প্রথম দিনেই স্বমহিমায় আবির্ভূত হলো ষষ্ঠ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। এবারই প্রথম প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের সংযোগ ঘটল এই সংগীত আসরে। বিপুলসংখ্যক শ্রোতা-দর্শকের আগমনে প্রথম দিনেই মুখরিত হলো উৎসব। অর্কেস্ট্রার বাদন, বেহালার সুরধ্বনি, সেতার-সরোদের স্নিগ্ধতার সঙ্গে খেয়ালের মায়াবি শব্দনিনাদ শ্রোতার অন্তরে বুলিয়ে দিল প্রশান্তির পরশ। সে সুবাদে যান্ত্রিক শহর ঢাকায় সুরের স্রোতধারায় বইল প্রাণের স্পন্দন।

উদ্বোধনী দিনে উৎসবের প্রথম পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন বিশ্বখ্যাত ভারতীয় বেহালাবাদক ড. এল সুব্রামানিয়াম। বেহালায় রাগ আভোগী পরিবেশন করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে মৃদঙ্গে শ্রীরামামূর্তি ধূলিপালা, তবলায় পণ্ডিত তন্ময় বোস ও মোর্সিংয়ে সত্য সাই ঘণ্টাশালা সঙ্গত করেন। বেহালার সুর থামতেই উৎসব আঙিনায় যেন ভেসে বেড়াতে শুরু করে অর্কেস্ট্রার সুর। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল কম্পোজিশনটি উপস্থাপন করে কাজাখস্তানের ৫৬ সদস্যের আসতানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রা। এরপর রাগ-রাগিণীর খেলা ছিল বাংলাদেশে বসবাসরত ভারতীয় শিল্পী রাজরূপা চৌধুরীর সরোদে। তিনি নামতেই মঞ্চে এরপর ভারতের গোয়ালিয়র, কিরানা ও জয়পুর ঘরানার কণ্ঠে খেয়াল পরিবেশন করেন ভারতের শিল্পী পদ্মা তালওয়ালকর। এরপর সেতার বাদনে অংশ নেন বাংলাদেশের শিল্পী ফিরোজ খান। তিনি নামতেই মঞ্চে ওঠেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষানবিশ সুপ্রিয়া দাস। তাঁর খেয়ালে মুগ্ধ হয় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা। ভোররাতে শেষ পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন ভারতীয় বংশীবাদক রাকেশ চৌরাশিয়া ও সেতারবাদক পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়।

গতকাল প্রধান অতিথি হিসেবে ষষ্ঠ উৎসব উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও আবাহনী লিমিটেডের সভাপতি সালমান এফ রহমান, স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ও স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু।

উৎসব উদ্বোধন করে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘এ উৎসবের প্রতিটিতেই উপস্থিত থেকেছি, এটা আমার সৌভাগ্য। এ উৎসবে আমরা পাঁচ দিন নৃত্যগীতের মধ্যে অবগাহন করব। আমরা সবার আগে মানুষ হতে চাই, নিজেদের রুচিকে উন্নত করতে চাই। এ উৎসব সে পথেই প্রেরণা জোগাবে।’

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘সংগীত পরিশুদ্ধ করে আমাদের, আমাদের চিত্তকে উদার করে, আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সংগীত আমাদের মুক্তচিন্তার অধিকারী করে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রেরণা জোগায়। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে সেই মূল্যবোধ, চেতনাকে ধারণ করতে চাই। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংগীত আমাদের শক্তি জোগাবে। উৎসবটি আমাদের মধ্যে সেই চেতনার বিকাশ ঘটায়।’

হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশে নয়, এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। বিশ্বের অন্যতম ধ্রুপদি উৎসবটি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শিল্পীদের টেনে এনেছে। মহান শিল্পীদের সংগীতে নিজেদের সমৃদ্ধ করব।’

উৎসব মঞ্চে আবুল খায়ের ঘোষণা দেন, আগামী বছর এ উৎসব উৎসর্গ করা হবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে, ২০১৯ সালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে এবং ২০২০ সালে ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুনকে।

আজকের উৎসবসূচি : উৎসবের দ্বিতীয় দিনে আজ বুধবার কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবেন অদিতি মঙ্গলদাস ড্যান্স কম্পানির নৃত্যশিল্পীরা। তবলা বাদনে অংশ নেবেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এরপর সন্তুর নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হবেন গত আসরগুলোয় শ্রোতাকে মুগ্ধ করা পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। খেয়াল পরিবেশন করবেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর। সেতার বাজিয়ে শোনাবেন ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খান। ধ্রুপদ পরিবেশন করবেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিত কুণ্ডু। সব শেষে থাকবে পণ্ডিত রনু মজুমদারের বাঁশি ও পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোসের সরোদে যুগলবন্দি পরিবেশনা।

উৎসবের নিয়মকানুন : অনলাইন নিবন্ধন করে যারা পাস সংগ্রহ করেছে কেবল তারাই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে পারবে। নিরাপত্তার স্বার্থে রাত ১২টার পর সব রকম প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। মাঠে ব্যাগ নিয়ে ঢোকা যাবে না এবং মাঠে ব্যাগ রাখার কোনো ব্যবস্থাও থাকবে না। তবে নারীরা আট ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি আকারের ছোট ব্যাগ বহন করতে পারবে। উৎসবস্থলে প্রবেশের জন্য সঙ্গে যেকোনো ধরনের শনাক্তকরণ পরিচয়পত্র রাখতে হবে। মাঠে একাধিকবার প্রবেশ ও প্রস্থান করা যাবে না। বারো বছরের কম বয়সী শিশুদের সঙ্গে আনা যাবে না। উৎসব আঙিনায় গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকছে না। এ ছাড়া এবার শ্রোতাদের আনা-নেওয়ার জন্য থাকছে না কোনো পরিবহনব্যবস্থা।

 

View Full Article