ভাঙল সুরের উৎসব
মামুন মিজানুর রহমান: হেমন্তের শিশিরস্নাত রাতে ছড়িয়ে পড়েছে সুর লহরি। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শীত। এরই মধ্যে শ্রোতারা মাথা দুলিয়েছেন বাদ্যের তালে তালে। গত রাতে শেষ হয়েছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব। বছর ঘুরে আবারও আগামী বছর এ উত্সব অনুষ্ঠিত হবে, এমন আশা নিয়ে শেষ হয়েছে এ বছরের আয়োজন। শেষ রজনী বলেই হয়তো, কিংবা চৌরাসিয়ার বাঁশির লোভেও হতে পারে, রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শ্রোতার উপস্থিতি ছিল বেশি।
পাঁচ দিনব্যাপী ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব-২০১৬’ শুরু হয়েছিল ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায়। নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নৃত্যনন্দনের ‘রবিকরোজ্জ্বল’ শিরোনামের নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল এ উত্সব। সম্প্রতি প্রয়াত সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হককে উত্সর্গ করা হয় এবারের উত্সব। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সবের এবারের আসর নিবেদন করেছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক।
উত্সবে সমাপনী দিনে গতকাল হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি ও পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার সন্তুরের
পরিবেশনা ছাড়াও দলীয় কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিল্পীরা। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। কুমার মারদুর শোনান খেয়াল। সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশন করেন আরতী অঙ্কালিকার।
গত রাতের পরিবেশনার শুরুতেই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিল্পীদের পরিবেশনায় কণ্ঠসংগীত। তারা পরিবেশন করেন রাগ ভূপালি। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন মো. জাকির হোসেন ও স্বরূপ হোসেন।
দলীয় সেতার বাদন শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা পরিবেশন করেন রাগ চারুকেশী। এই দলে ছিলেন নিশিত দে, সাম্য দে, আশীষ নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিত্ মণ্ডল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টিএম সেলিম রেজা, খন্দকার নাজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জী, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ, মো. কাওছার প্রমুখ। উচ্চাঙ্গসংগীতে দেশের শিল্পীরাও যে এগিয়ে যাচ্ছেন, তা-ই বোঝা গেল তাদের পরিবেশনায়।
এই দুই পরিবেশনার পরই ছিল উত্সবের সমাপনী আয়োজন। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও স্কয়ারের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আবুল খায়ের। সভাপতি ছিলেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।
সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরুতে গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেন, এ উত্সব আমার বন্ধু সৈয়দ হককে উত্সর্গ করা হয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে বড় বহুমাত্রিক লেখক।
তিনি আরও বলেন, আগামী কয়েক বছর যদি বেঁচে থাকি, আশা করি, দশম উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সবও উপভোগ করতে পারব। আমাদের রক্তের মধ্যে উচ্চাঙ্গসংগীতের ধারা বইছে। এ উত্সব নিয়মিত হলে এখান থেকেই বড় শিল্পী বের হয়ে আসবেন।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, আমরা গত কয়েক দিন ধরে এ উত্সব উপভোগ করছি। আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা যখন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, তখন এ উত্সবের আয়োজন। এই আয়োজন একটি অসাধারণ ঘটনা।
সমাপনী আয়োজন শেষে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা। পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার হাতের ছোঁয়ায় সন্তুরের সুরে ছড়িয়ে পড়ে অপূর্ব মূর্ছনা। কাশ্মীরি লোকসংগীতে ব্যবহূত হয় সন্তুর। পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা সন্তুর বাদনে দিয়েছেন নতুন মাত্রা।
সন্তুরের পর খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন কুমার মারদুর। কুমার মারদুর ধারাওয়াড় গায়নরীতির একজন কুশলী কণ্ঠশিল্পী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি সংগীত পরিবেশন করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি।
অনুষ্ঠানের এ পর্বে সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। তিনি ভারতের একজন বিশিষ্ট সেতার ও সুরবাহার শিল্পী। সেতারের তারে তারে সুরের ধারা বইয়ে দেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
এবারের উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সবে প্রায় প্রতিদিনই ছিল খেয়াল পরিবেশনা। সমাপনী দিনেও ছিল খেয়াল। গত রাতে খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতী আঙ্কালিকার। সুকণ্ঠী এই গায়িকার তাল ও সুরের চমত্কার খেলা এক মোহময় আবহের সৃষ্টি করে। তবলায় সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার।
পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে শেষ হয় এই উত্সব। তিনি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ। ভারত সরকার তাকে পদ্মবিভূষণ, সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার ও ন্যাশনাল অ্যামিনেন্স অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে। ডাচ রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব ওরাঞ্জন্যাসো’ খেতাব এবং ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে নাইট উপাধি লাভ করেছেন। তিনিই ছিলেন সমাপনী দিনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এভাবেই বাঁশির সুরে উদিত হয় ভোরের সূর্য।