ভাঙল সুরের মায়াজাল
স্টেডিয়াম ভর্তি বিপুল দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে ভাঙল পঞ্চরজনীর সুরের বিপুল আয়োজন। গত কয়েক বছরের নিয়মে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরি বাঁশির সুরে শেষ হলো সকল আনুষ্ঠানিকতা। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত যে এত দর্শকপ্রিয়তা পেতে পারে, দিতে পারে ভিন্নতার স্বাদ, তা গত পাঁচ দিনে টের পেয়েছেন আর্মি স্টেডিয়ামসহ মাছরাঙা টেলিভিশনের দর্শকরা। শাস্ত্রীয় নৃত্য, কণ্ঠের খেলায় কখনো খেয়াল, কখনো ধ্র“পদী, বেহালা, যন্ত্রসঙ্গীতে সেতার, সরোদ, সন্তুর, ম্যান্ডোলিন, কখনোবা বাঁশি, তবলার আলাদা আলাদাভাবে দীর্ঘ সময়ের পরিবেশনা শ্রোতারা উপভোগ করছেন। সন্ধ্যা হলেই তারা সুর-মূর্ছনায় মোহিত হতে ছুটে আসতেন বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। ভোরে পর্যন্ত বুঁদ হয়ে থাকতেন সুরের মায়াজালে। আসর ভাঙলে দেখা যেত প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার মানুষ দলে দলে বাড়ি ফিরছেন। রাজধানী ঢাকার বুকে এমন দৃশ্য সত্যিই বিরল। সমাপনী দিনেও মানুষের আগমন ঘটেছিল অন্য দিনের প্রায় দ্বিগুণ।
গতকাল উৎসবের সমাপনী দিনে অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীদের দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এরপর দলীয় সেতার বাজিয়ে শুনিয়েছেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ পর্যায়ে ছিল সমাপনী আয়োজন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দণি সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।
সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্যায়ে সন্তুরের মোহনীয় সুরে ভাসান অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা। রাতে খেয়াল পরিবেশনের কথা কুমার মারদুর। এ ছাড়া সেতার পরিবেশনে ছিলেন পণ্ডিত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশনে আরতী অঙ্কালিকার। শেষ রাতে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে সুরে শেষ এই অনিন্দ উৎসব।
চতুর্থ দিনের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল। শৈশব থেকেই অজয় চক্রবর্তীর বিরল সাঙ্গীতিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে। হাতেখড়ি পিতা অজিত চক্রবর্তীর কাছে। এরপর পণ্ডিত কানাইদাস বৈরাগী, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁর ছেলে ওস্তাদ মুনব্বর আলি খান এবং পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের মতো প্রবাদপ্রতিম গুরুদের কাছে তালিম নেন। নিবিড় প্রশিক্ষণ ও স্বীয় অধ্যবসায়ের গুণে অজয় চক্রবর্তী পাতিয়ালা-কসুর ঘরানা ছাড়াও অন্যান্য প্রধান ঘরানার বৈশিষ্ট্য রপ্ত করতে সমর্থ হন। আইটিসি-সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির শুরু থেকেই তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি সেখানে প্রথম স্কলার হিসেবে যোগদান এবং পরে সর্বকনিষ্ঠ গুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গুরু ও বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি এখনো আইটিসি-সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে বহাল আছেন। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর পুরস্কার ও অর্জনের তালিকা দীর্ঘ। পদ্মশ্রী, আইটিসি-এসআরএ স্বর্ণপদক, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, ৪৫ অনূর্ধ্ব সেরা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কুমার গান্ধর্ব পুরস্কার, আলভার ভিরাসাত পুরস্কার, বঙ্গ বিভূষণসহ অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। অজয় চক্রবর্তী রাগ বিলাসখনি তরী ও কুন্তল বাড়ালি পরিবেশন করেন। সবশেষে রাগ ভৈরবীতে ভজন পরিবেশন করে শেষ করেন তার পরিবেশনা। তবলায় ছিলেন সৌমেন সরকার, তানপুরায় অভিজিৎ কুণ্ডু ও হারমোনিয়ামে অজয় যোগলেকার। পরিবেশনা শেষে শিল্পীকে উৎসব স্মারক প্রদান করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
সঙ্গীত উপভোগের পাশাপাশি শ্রোতাদের জন্য খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা ছিল উৎসব প্রাঙ্গণে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টলে পাওয়া গেছে আইস মিডিয়ার ম্যাগাজিন ও বেঙ্গল পাবলিকেশনসের বই। অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে আরো ছিল অরণ্য, বেঙ্গল ক্রিয়েশনস, ম্যাংগো মোবাইল, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপ ও সেটেলমেন্টের প্রদর্শনী ‘আগামীর ঢাকা’। ছিল ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ। আয়োজন সর্মথন করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। অনুষ্ঠানে সম্প্রচার সহযোগী মাছরাঙা টেলিভিশিন। মিডিয়া পার্টনার আইস বিজনেস টাইমস। আতিথেয়তা সহযোগী র্যাডিসন হোটেল। সার্বিক সহযোগিতায় বেঙ্গল গ্রুপ। অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে বেঙ্গল ডিজিটাল, ম্যাংগো, বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয় ও পারফেক্ট হারমনি প্রোডাকশনস্ সিঙ্গাপুরের সহযোগিতায়। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় ব্লুজ কমিউনিকেশনস।
গত চার বছর ধরে আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব’ শিল্পী ও দর্শকের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশে তথা বিশ্বে সর্বাধিক বড় পরিসরে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বছর উৎসবটি উৎর্সগ করা হয় লেখক সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।