ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের শিকড় বাংলাদেশে
দেবজ্যোতি বোস সরোদ বাজান। প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে যোগ দিতে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। এর আগে এসেছিলেন শিল্পকলার এক উৎসবে যোগ দিতে। চার পুরুষ সংগীতের সঙ্গে জড়িত এবং গর্বের সঙ্গেই তিনি বলেন, ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের ৬০ শতাংশ শিকড় বাংলাদেশে। বাবা বিশ্বনাথ বোস তবলার কিংবদন্তি ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সাংবাদিকদের সামনে আসেন এই গুণী শিল্পী।
তবলায় হাতেখড়ি ছিল। গান লেখেন, সুর করেন। চলচ্চিত্রে ব্যবহার হচ্ছে এসব গান। অ্যালবামও বের হয়েছে বেশ কিছু। সরোদে কিংবদন্তি ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন দেবজ্যোতি।
কলকাতার মানুষ। বাংলায়ই বললেন সব কথা। সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ খোলামেলা আলোচনা করলেন দেবজ্যোতি। বক্তব্যে সংস্কৃতি থেকে অর্থনীতির বিষয়টিই বেশি প্রাধান্য পায়। এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি দুটো বিষয় কোনোভাবেই আলাদা নয়। আপনাকে আমাকে সবাইকে খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে, সেটা তো অস্বীকার করছিই না। বাঁচা যদি কেবল শরীরের নিচের দিকটার জন্য হয় সেটাকে তো আর বাঁচা বলে না। ওপরের দিকটার কথাও তো ভাবতে হবে।’
কালের কণ্ঠ পত্রিকা সম্পর্কে জানেন দেবজ্যোতি। প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর তিনি বলেন, ‘এই কাগজের বড় একজনের সঙ্গে একবার আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনি হলেন ইমদাদুল হক মিলন। একটা অনুষ্ঠানে কথা হয়েছিল।’
এর আগে সংবাদ সম্মেলনে উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে মানুষ কেন দূরে সরে যাচ্ছে সে বিষয়ে দেবজ্যোতি বলেন, ‘সংকটই হলো সৃজনশীলতার উৎস। আপনি যদি সংকটের মুখে নাই পড়েন, সৃজনশীলতা থেমে যাবে। সমস্যাটা হচ্ছে—রাষ্ট্র শেখাল যে শুধু টাকাই তোমাকে বাঁচাবে।’
দেবজ্যোতি বলেন, ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা আমি বলতে চাই। একটি হচ্ছে—পড়ালেখার পরে এখনো বুঝতে পারিনি কেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীত অথবা ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত, কারণ আমার প্রায় ৬০ শতাংশ মূল বাংলাদেশের। আমার পূর্বপুরুষ, অক্ষয় কুমার বোস প্রথম তবলা বাজান আমাদের পরিবারে। আমি একমাত্র দলছুট, সরোদ বাজাই। কিন্তু আমারও শুরু তবলাতে। আমাদের পাশেই, যেখানে আমি থাকি শ্যামবাজারে, অনাথ বোস তাঁর পুরো মূল বাংলাদেশে। তাঁর বাড়িতেও ওস্তাদ বাদল খাঁ সাহেব সারেঙ্গী দীর্ঘদিন বাজিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের। এনায়েত খাঁ সাহেবদের পরিবার বাংলাদেশের। বাবা আলাউদ্দিন-এত! রাজনৈতিক কারণে ভাগাভাগি হলেও সংগীত তো আর ভাগাভাগি করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘যখন কেউ সংগীত শিক্ষা নিচ্ছে, কী নৃত্য শিক্ষা নিচ্ছে, সেই বিশ্বাসটা রাখতে হবে যে আমি একটা জিনিস যদি সঠিকভাবে শিখি তাহলে আমার অন্তত জীবিকার অভাব হবে না।’ সংগীত শেখার বিষয়ে অভিভাবকদের মানসিকতার উন্নয়নের কথা বললেন দেবজ্যোতি বোস।
প্রথমবারের মতো বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে এলেও এই আয়োজন সম্পর্কেও দেবজ্যোতি বোসের উচ্চ ধারণা। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে এই অনুষ্ঠানটি কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম অনুষ্ঠান। পৃথিবীর সব দেশ আমার ঘোরা হয়ে গেছে, কোথাও এমন হয় না। নিশ্চিয়ই শ্রোতা না থাকলে এটা হতো না। দ্বিতীয়ত, রাতের পর রাত জেগে এই যে গান শুনছে, ভারতের শিল্পীরাও আশা করে বসে থাকেন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যদি ডাকে তাহলে ভালো করে কিছু শোনাব।’ তিনি বলেন, ‘ধন্যবাদ বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে—তারা এত চেষ্টা করছে, এত লড়াই করছে। আমাদের ধারণা আমরা বাংলাদেশ থেকে অনেক ভালো ভালো শিল্পী পাব, যারা ভারতে এবং সারা পৃথিবীতে গানবাজনা করবে।’
সরোদ কেন বেছে নিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে দেবজ্যোতি বোস বলেন, ‘আমরা খুব ছোটবেলা থেকে আলী আকবর খাঁ এবং আমার গুরু আমজাদ আলী খাঁকে খুব কাছে পেয়েছি। মা ছাত্রী ছিলেন। বাবা অনেক বাজাতেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে।’
দেবজ্যোতি মনে করেন, বাঁচার জন্য খুব কমই প্রয়োজন—কোনো রকম ত্যাগ স্বীকার না করেও মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। দেবজ্যোতি বলেন, ‘আমার হয়তো পরিসর ছোট। আমি আমজাদ আলী খাঁও নই। কিন্তু আমার বাঁচতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সবই আছে।’
কল্যাণমূলক একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন দেবজ্যোতি। তিনি বলেন, ‘আমরা গানবাজনা করি, যেটাকে উপলক্ষ করে টাকা ওঠে। সেই টাকাটা দিয়ে আমরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বীমা করে দিই যাতে তারা বিপদে-আপদে বাঁচে।’ বন্ধুবান্ধব অনেককেই এমন কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ দিয়েছেন দেবজ্যোতি বোস।
আজ আবাহনী মাঠে আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চঙ্গসংগীত উৎসবের ষষ্ঠ আসরের দ্বিতীয় দিনের শেষ আকর্ষণ দেবজ্যোতি। জুগলবন্দি করবেন রুনু মজুমদারের সঙ্গে। যোগেশ শামসী ও অভিজিত ব্যানার্জি তবলা বাজাবেন।