মোহনবাঁশির সুরে সমাপনী
ছিলেন কুস্তিগির, হয়েছেন বংশীবাদক। নিজের বাদন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাঁশি বাজাই না, প্রার্থনা করি।’ তিনি পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। গতকাল শনিবার তার মোহনবাঁশির সুরে শেষ হলো পাঁচ দিনের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব।
এর আগে গত চার দিনে উপমহাদেশের ওস্তাদ-পণ্ডিত আর বাংলাদেশি নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের পরিবেশনায় যে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল, গতকাল শেষ দিনেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষণ হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া হলেও, সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া এ আয়োজনে আরও ছিল ওড়িশি নৃত্য, মোহনবীণা, সেতার আর খেয়ালের পরিবেশনা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয় শিক্ষাবিদ-সংস্কৃতিজন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে।
পঞ্চম ও শেষ দিনের আয়োজন শুরু হয় ওড়িশি নৃত্যের মধ্য দিয়ে। বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র মঞ্চ আলোকিত করেন ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। পরিবেশনাটি ছিল অর্ধনারীশ্বর ও রামায়ণ-লঙ- এ দুই পর্বে বিভক্ত। রাগমল্লিকা ও তালমল্লিকা ভিত্তিক প্রথম পর্ব অর্ধনারীশ্বরের নৃত্য পরিচালনা ও রচনা করেছিলেন প্রয়াত গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র; সঙ্গীতায়োজন ছিল পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্রের। ওড়িশি রামায়ণ থেকে নেওয়া দ্বিতীয় পর্ব রামায়ণ-লঙ-এর নৃত্য পরিচালনায় প্রয়াত পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের করা; সঙ্গীত পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্রের। নৃত্যনাট্যটিতে সুজাতা মহাপাত্রের সহশিল্পী ছিলেন সৌম্য বোস, বাঁশিতে ছিলেন সৌম্যরঞ্জন যোশি, রূপক কে পারিদা, বেহালায় রমেশ চন্দ্র দাস, পাখোয়াজে একলব্য মুদুলি এবং আলোক সঞ্চালনায় জয়দেব দাস।
নৃত্য শেষে শুরু হয় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের সমাপনী অধিবেশন। এ অংশে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে মঞ্চে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ছায়ানট সভাপতি সঙ্গীতজ্ঞ ড. সন্জীদা খাতুন, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং আবাহনী লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী নাবিল আহমেদের পক্ষে তার মা আমিনা আহমেদ।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, দেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের চর্চা যখন ম্রিয়মাণ, তখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এই উৎসব উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চার প্রসার ঘটাচ্ছে। স্থান-কালের পরিবর্তন হলেও নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে আয়োজনের মাধ্যমে শ্রোতারা সঙ্গীত উপভোগ করতে পেরেছেন। উৎসব উৎসর্গের বিষয়ে তিনি বলেন, উৎসবটি উৎসর্গ করায় আমার আনন্দের অন্ত নেই। জীবদ্দশায় এমন সম্মান পাওয়া প্রসঙ্গে রসিকতাও করেন তিনি।
ফজলে হাসান আবেদ বলেন, শিল্প-সাহিত্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ। তাই অনেক আশঙ্কা কাটিয়ে এই উৎসব আয়োজন করতে পারা অনেক ইতিবাচক ব্যাপার।
সন্জীদা খাতুন বলেন, সংস্কৃতির নিহিত শক্তি নিয়ে নাটক, গান, আবৃত্তি নিয়ে যতই মানুষের কাছে যাওয়া যায়, ততই মানুষকে সচেতন করা যাবে। তাতে মানুষের মনে আলো জ্বালানো যাবে।
সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মোহনবীণায় সুর তোলেন পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। বিশ তারের হাওয়াইন গিটার-সদৃশ এ যন্ত্রে তিনি সুর তোলেন। তিনি শুরুতেই পরিবেশন করেন মারু বেহাগী। এর পর রাজস্থানি ধুন পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তিনি তার পরিবেশনা শেষ করেন।
এর পর পরে কণ্ঠে সুরের চারপাশ ছড়িয়ে দিয়ে খেয়াল পরিবেশন করেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। বিষ্ণুপুর ঘরানার এ শিল্পীর পরিবেশনা শেষে মঞ্চে যৌথ সেতার বাদনে অংশ নেন উত্তর ভারতের শিল্পী পণ্ডিত কুশল দাস এবং সেনিয়া মাইহার ঘরানার শিল্পী কল্যাণজিৎ দাস। এর পরে খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত কৈবল্যকুমার। কিরানা ঘরনার তৃতীয় প্রজন্মের এ শিল্পী তার স্বভাবসুলভ তাল পরিবেশন করেন। দিনের এবং এবারের উৎসবের সব শেষে ছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিবাদন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবের এবারের আয়োজন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের পরিবেশনার পাশাপাশি উৎসব প্রাঙ্গণে আরও ছিল বাংলাদেশের সঙ্গীত সাধক ও তাদের জীবনী নিয়ে সচিত্র প্রদর্শনী। এ ছাড়া বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্ট আয়োজন করে ‘সাধারণের জায়গা’ শীর্ষক স্থাপত্য প্রদর্শনী।
শুক্রবার মধ্যরাতের আয়োজন :শুক্রবার মধ্যরাতে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খানের খেয়াল শেষে ছিল সরোদ এবং বেহালার যুগলবন্দি। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ একসঙ্গে পরিবেশন করেন রাগ সিমেন্দ্রমধ্যম। এ সময় তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার। এরপর খেয়াল পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত যশরাজ। তিনি প্রথমে রাগ যোগে এ খেয়াল পরিবেশন করেন এবং পরে দুর্গা রাগে ভজন পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন রামকুমার মিশ্র, হারমোনিয়ামে পণ্ডিত তৃপ্তি মুখার্জি, কণ্ঠে রত্তন মোহন শর্মা এবং মৃদঙ্গমে শ্রীধার পার্থসারথি। খেয়াল শেষে প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে চেলোর পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। তিনি রাগ নন্দকোষ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ এ দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডু ও টিংকু কুমার শীল। উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির সেতার। তিনি রাগ ললিত বিল্লার গৎ ঝালা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সৌমেন নন্দী।
এবারের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের সম্প্রচার সহযোগী ছিল চ্যানেল আই, মেডিকেল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, ইভেন্ট ব্যবস্থাপক ব্লুজ কমিউনিকেশনস এবং আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল সিঙ্গাপুরের পারফেক্ট হারমনি।