যন্ত্রের মোহে ভাসল সুর
শরীফা বুলবুল : যন্ত্রের মোহে সুর যখন খেয়ালে মেলে পাখা তখনই তৈরি হয় মোহাচ্ছন্নতা। শ্রোতারা হারিয়ে যায় সুরের অন্যলোকে। সুর-তাল-লয় তাদের নিয়ে যায় সঙ্গীতের স্বর্গলোকে।
দ্বিতীয় রাতটাও এসেছিল সুরের ইন্দ্রজাল নিয়ে। তবে তা অন্যভাবে। যন্ত্র যেন এখানে প্রভাবক। সুর যেন মোহে পড়ে যন্ত্রের। সুরের স্রষ্টা যেন এখানে কণ্ঠ নয়, মানব নয়, যেন যন্ত্রই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। আর তাই যন্ত্রের মোহে পড়ে যান শিল্পীরাই।
গতকাল শুক্রবার সুরের যাত্রা শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায়। ওডিশি নৃত্য পরিবেশন করেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগাল। অনবদ্য এ পরিবেশনা সবাইকেই মুগ্ধতায় ভাসিয়ে দেয়। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাব ও ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে ‘শেভালিয়ে দ্য লর্দ দেজার্ত এ দ্য লেত্র’ সম্মাননা অর্জন করা ওডিশি নৃত্যধারার খ্যাতিমান প্রবক্তা শিল্পী মাধবী মুডগাল মন্ত্রমুগ্ধে ভরে দেন। নৃত্য পরিবেশন করেন তার ভ্রাতুষ্পুত্রী ও শিষ্যা আরুশি মুডগাল। প্রথমে নটরাজ পরিবেশনা করেন মাধবী মুডগাল।
এরপর বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা দলীয় তবলা পরিবেশন করেন। চিন্ময় ভৌমিক, ফাহমিদা নাজনীন সুমাইয়া, এম জে জে ভূবন, নুসরাত-ই-জাহান খুসবু, পঞ্চম স্যানাল, প্রশান্ত ভৌমিক, সুপান্থ মজুমদার তবলা পরিবেশনা প্রশংসায় ভরে দেয়।
খেয়াল শোনান বাংলাদেশের শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। তবলায় তাকে সঙ্গত করেন ইফতেখার আলম প্রধান। প্রিয়াঙ্কা গোপ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তার পুরো পরিবেশনাতেই। ইফতেখার আলম প্রধান দেশের প্রতিষ্ঠিত তবলাশিল্পী। ২০১৬ সালে ইফতেখার লন্ডনের প্রখ্যাত রয়েল অ্যালবার্ট হলে ‘অ্যা ক্ল্যাসিকাল অডিসি : ট্রিবিউট টু রবিশঙ্কর’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পীদের সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে তবলা পরিবেশন করেন।
এরপর ছিল আরেক আকর্ষণ রাহুল শর্মার সন্তুর পরিবেশনা। সন্তুরের শ্রæতি মধুর সুর যেন আরো এক ধাপ ছাপিয়ে যায় শিল্পীর অনবদ্য পরিবেশনায়। কণ্ঠসঙ্গীত ও সন্তুর বাদনে রাহুল শর্মার হাতেখড়ি তার বাবা প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতবেত্তা পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার কাছে। তিনি রিচার্ড ক্লেডারম্যান ও কার্সি লর্ডসহ খ্যাতিসম্পন্ন বহু গায়ক ও বাদকের সঙ্গে একই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। রাহুল শর্মাকে তবলায় সঙ্গত করেন আরেক জনপ্রিয় তবলিয়া সত্যজিৎ তালওয়ালকার। বাবা স্বনামধন্য তবলিয়া পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকার ও মা বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকারের কাছে সত্যজিৎ তালওয়ালকারের হাতেখড়ি। বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি একজন চৌকস তবলাশিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। ওয়ার্ল্ড মিউজিক, ফিউশন ও জ্যাজেও তার আগ্রহ অনেকেরই জানা। লুই ব্যাঙ্কস ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পারকাশনিস্ট ত্রিলোক গুর্তুর সঙ্গে তিনি একই মঞ্চে বাজিয়েছেন।
দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ শোয়েব ও অন্যরা। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন ইফতেখার আলম প্রধান, পাখওয়াজে সুষেণ কুমার রায়। সেতার পরিবেশন করেন পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ভারতের প্রখ্যাত এই সেতারবাদক সেনিয়া মাইহার ঘরানায় আবহে কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। শঙ্কর মহাদেবন ও ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে যুগল পরিবেশনা করেছেন অনেকবার।
এই উৎসবের অনেকটাই নিয়মিত শিল্পী পণ্ডিত উলহাস কশলকর। তিনি খেয়াল পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সুরেশ তালওয়ালকার। পণ্ডিত উল্লাস কশলকারের হাতেখড়ি বাবা এনডি কশলকারের কাছে।
আরেক আকর্ষণ পণ্ডিত রনু মজুমদারের বাঁশি ও ইউ রাজেশের ম্যান্ডোলিনের যগলবন্দি পরিবেশনা। রনু মজুমদার ভারতের একজন প্রতিষ্ঠিত বংশীবাদক। তার প্রকৃত নাম রনেন্দ্রনাথ মজুমদার তবে রনু মজুমদার নামেই তিনি বেশি পরিচিত। মাইহার ঘরানার এই বাদ্যশিল্পী আর্ট অব লিভিং অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে ৫ হাজার ৩৭৮ জন বংশীবাদকে উপস্থাপন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিষয়টি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। আর ইউ রাজেশ ভারতের একজন বিশিষ্ট ম্যান্ডোলিন শিল্পী। ম্যান্ডোলিনের স্বনামধন্য শিল্পী ইউ শ্রীনিবাসের ভ্রাতা ইউ রাজেশ তার বাবা ও ভাইয়ের কাছে তালিম নেন। জন ম্যাকলফলিনের অ্যালবাম ‘ফ্লোটিং পয়েন্টে’ ম্যান্ডোলিন বাদনের জন্য গ্র্যামি পদকের জন্য তিনি মনোনয়ন লাভ করেছিলেন।
এভাবে ম্যান্ডোলিন আর বাঁশির মধুর পরিবেশনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় বেঙ্গল উচ্চঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় রজনীর পরিবেশনা। এরপর সুরের মোহে আবেশে সবাই বাড়ির পথ ধরে।
শনিবারের পরিবেশনা : উৎসবে তৃতীয় দিন অর্থাৎ শনিবারের পরিবেশেনা শুরু হবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীদের দলীয় সরোদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। বাঁশি বাজিয়ে শোনাবেন শশাঙ্ক সুব্রহ্ম্যণন। তার সঙ্গে মৃদঙ্গমে থাকবেন পারুপল্লী ফাল্পুন, তবলায় সত্যজিৎ তালওয়ালকার। খেয়াল পরিবেশন করবেন ড. প্রভা আত্রে। তার সঙ্গে তবলায় থাকবেন রোহিত মজুমদার। তবলা বোলে মাত করবেন পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার পরিবেশন করবেন ধ্রæপদ। সেতার বাজিয়ে শোনাবেন পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবলায় থাকবেন পরিমল চক্রবর্তী। ওস্তাদ রশিদ খানের খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তৃতীয় দিনের পরিবেশনা। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করবেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।