Menu

যে দেশের কাদা-জলে সুর ভাসে …

 

যে দেশের বাতাসে সুর ভেসে বেড়ায়, সেখানে বিশ্বের বৃহত্তম উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব আয়োজিত হচ্ছে, এ জন্য আমি খুবই আনন্দিত। বাংলাদেশের খাল-বিল, কাদামাটির প্রভাব পড়েছে এদেশের মানুষের মননে ও মানসে, তাদের করে তুলেছে উদার ও সহনশীল। যুগ যুগ ধরে এদেশের মানুষ চলেছে জলপথে, শত দুঃখে, বিপর্যয়ে খুঁজেছে সামত্মবনা নৌকার দুলুনিতে। গাঁয়ের মেঠোপথে গরম্নর গাড়ির অসম গতি, পড়মত্ম বিকেলে ভেসে আসা কোকিলের কুহুতান ও বিসত্মীর্ণ সবুজে ধান কাটার মন্দ্র গতি মানুষের হৃদয়কে স্পন্দিত করে। প্রাত্যহিক জীবনে সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা ছন্দ লুকিয়ে আছে।

নদীতে ঢেউ ভাঙার শব্দ, ঝড়ো হাওয়া, প্রবল বৃষ্টি ও বজ্র-বিদ্যুতের তা-ব – সব মিলিয়ে প্রকৃতিই যেন আমাদের চারদিক শব্দে ও সুরে ভরে দিয়েছে। প্রকৃতির এই নানান লয়ের অনুরণন মানুষের মনে সুর ও ছন্দের বোধ তৈরি করেছে।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, ক্ষমতাকেন্দ্রের অনেক দূরে অবস্থিত কৃষিপ্রধান এই সমাজে, উচ্চমানের শিল্পকলা, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গসংগীত ও নৃত্য বিকশিত হওয়া কি আসলেই সম্ভব ছিল? এর উত্তর পাওয়া মুশকিল। কিছু প্রাচীন ভগ্নপ্রায় ইমারত, কারম্নশিল্পের নিদর্শন, কিছু বই, স্মৃতিকথা ও পুরনো ছবি ছাড়া এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা যায়, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পূর্ববঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতার চাকচিক্য কিছুটা কম হলেও শিল্পীকলার প্রতি অনুরাগ ও যত্নের কোনো অভাব ছিল না।

এটা লক্ষণীয়, উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যজগতের বহু কৃতবিদ্য মানুষ ও গুণী শিল্পীর জন্ম হয়েছে এই বাংলাদেশের মাটিতে। এই মাটিতে ছড়িয়ে থাকা অজস্র লোকসংগীতের সুর, বাণীই হয়তো এদেশের সাধারণ মানুষকে করেছে সংগীতপ্রীয়। শত শত বছর ধরে নদী-কাদা-জলের এই দেশ বহু সংগীতগুণীকে লালন করে তাঁদের তুলে ধরেছে বিশ্বের দরবারে।

বাংলা গানের প্রতি, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি আমার বহুদিনের আসক্তি। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা বোঝার চেষ্টা করি। ভালো গানের জন্য প্রয়োজন ভালো গীতিকার, ভালো লেখক। আর ভালো লেখা পেতে হলে প্রয়োজন সাহিত্যচর্চার ও মননশীল আলোচনার গ্রহণযোগ্য পস্ন্যাটফর্ম। সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই বাংলা সাহিত্য মাসিক কালি ও কলম প্রকাশ করি। ভাবতে ভালো লাগছে, কালি ও কলম একটি মানসম্মত সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে সমাদর পেয়েছে এবং এ-বছর দশম বর্ষে পদার্পণ করছে।

আবার সংগীতের কথায় ফিরে আসি। সুর ও বাণী নিয়েই নিবদ্ধ বাংলা গান। আর তা সঠিকভাবে পরিবেশনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সুরেলা কণ্ঠের। একটি গান তালে-লয়ে-সুরে গাইতে পারবেন সেই ব্যক্তি, যাঁর প্রতিভা ও সংগীতের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান আছে। আমাদের দেশে সুরেলা কণ্ঠ বা সুন্দর গায়নশৈলী আছে এমন প্রতিভাবান শিল্পীর অভাব নেই। তবে দÿ গায়কের বুনিয়াদ তৈরি হয় শাস্ত্র¿ীয় সংগীতে প্রশিÿণ গ্রহণ করে। এই প্রশিÿণ তুলনামূলক কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেÿ এবং কঠিন অধ্যবসায়ের দাবিদার। তাই  উচ্চাঙ্গসংগীতে মনোনিবেশ করা থেকে অনেকেই বিরত থাকেন। বিষয়টি এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা দেয় বলে দীর্ঘদিন গানের সঠিক মান বজায় রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

শুধু ভালো গানের গলা দিয়ে এই সংকট পূরণ করা সম্ভব নয়। অনিশ্চিত ও দুর্বল অবস্থান থেকে বাংলা গানকে বাঁচাতে হলে একে অবশ্যই মূল থেকে শক্তি জোগাতে হবে। নিয়ম মতো উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চার মধ্য দিয়েই এর ভিত গড়ে তুলতে হবে। এ এক দুরূহ পথ। এর জন্য প্রয়োজন পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও সাধনা, যার কোনো বিকল্প ও সংক্ষিপ্ত পথ নেই। আর এ কারণেই অনেকে এই দুরূহ পথ পরিহার করে সহজ ও দ্রম্নত খ্যাতির পথে পাড়ি দেন। আমি মনে করি, আমাদের চিমত্মা- চেতনায় একটা পরিবর্তন আনা দরকার। এ শুধু আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলে চলবে না, একে হতে  হবে শ্রোতৃম-লীর সজ্ঞান উপলব্ধি। শ্রোতাদের কান যখন তৈরি হবে, তখন মধ্যম মানের কোনো পরিবেশনাই আর গ্রহণযোগ্য হবে না। তখন এমনিতেই ভালো গান স্থায়ী জায়গা করে নেবে।

শ্রোতার মনন ও রম্নচি তৈরির লক্ষ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির সঙ্গে নানান যৌথ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে রক্ষার ও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই ১৯৭৭ সালে আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (এসআরএ) কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। গুরম্ন-শিষ্যপরম্পরা রীতিতে এখানে সংগীতশিক্ষা দেওয়া হয়। সংগীতরম্নচি তৈরিও এদের লক্ষ্য। আমাদের পারিবারিক বন্ধু সেতারবাদক আলিফ লায়লার পরিচয়সূত্রে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও আইটিসি এসআরএর মধ্যে সংযোগ গড়ে ওঠে। আমি কৃতজ্ঞ এজন্য যে, এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক লক্ষ্য একই সঙ্গে পূরণ করা সম্ভব।

এই যোগাযোগ আমাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী তাৎপর্যময় কার্যকর সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করেছে।

‘বেঙ্গল আইটিসি এসআরএ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১২’ এই দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে বৃহত্তম আয়োজন। শুধু তাই নয়, শিল্পীর সংখ্যা, উৎসবের সময়কাল এবং শ্রোতার সংখ্যা হিসেবে এটিই বৃহত্তম উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। বাংলাদেশের সংগীতরসিকদের এবং সংগীতের ছাত্রদের জন্য এমন একটি বড়মাপের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারছি বলে আমি খুবই আনন্দিত।

অতীতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ১৯৯৬ সালে শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলন আয়োজন করেছে। এতে সারা বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর ওসত্মাদ মাশকুর আলী খান ও বিদুষী শামিত্ম শর্মার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় পরম্পরা উচ্চাঙ্গসংগীত কর্মশালা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বহু আগে থেকে উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষায় বৃত্তি প্রদান করে আসছে। অদূর ভবিষ্যতে আইটিসি এসআরএর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি মানসম্মত উচ্চাঙ্গসংগীত প্রশিÿণ অ্যাকাডেমি স্থাপন আমাদের লÿ্য। এটা খুবই আশাপ্রদ যে, অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনও উচ্চাঙ্গসংগীত ও নৃত্যকে গুরম্নত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে শুরম্ন করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চার একটা ÿÿত্র তৈরি হয়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে, এদেশের শিল্পীদের যদি দেশের বাইরে মানসম্পন্ন শ্রোতার কাছে সংগীত পরিবেশনের সুযোগ করে দিতে না পারি তাহলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে না। এ ব্যাপারে আইটিসি এসআরএ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতবর্ষের নানা পস্ন্যাটফর্মে বাংলাদেশের নির্বাচিত শিল্পীদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা তারা করবে। এই সবকিছুর মূলে হলো উচ্চাঙ্গ নৃত্য ও গীতের সূক্ষ্ম সুর ও রস উপলব্ধি করতে পারবেন এমন শ্রোতৃম-লী তৈরি করা। এই লÿÿ্য আমরা ইতোমধ্যে প্রতি দুমাস অমত্মর উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর আয়োজন শুরম্ন করেছি। আমরা আশা করছি, চার দিনব্যাপী এই মহোৎসব আমরা প্রতিবছরই আয়োজন করব।

আমরা আগামী বছর ফেব্রম্নয়ারিতে আইটিসি এসআরএর সঙ্গে কলকাতায় বাংলা গানের বৃহত্তম উৎসব আয়োজন করব। বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রতিভা কলকাতার শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরাই এই উৎসবের লক্ষ্য।

অনেক স্বপ্ন আমি দেখি, সব স্বপ্ন হয়তো কখনো পূরণ হবে না। তবু দেশের জন্য বড় কিছু, ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখা থেকে হয়তো আমি কখনই ক্ষামত্ম হব না।

 

আবুল খায়ের

সভাপতি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

 

 

thumbnail

 

ঢাকা গান ও তালের শহর

 

‘অ্যা মিউজিক্যাল পিপল’, ১৮৪০-এ ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল ডেভিডসন ঢাকার অধিবাসীদের এভাবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

‘ঢাকার জনসাধারণের মাঝে বাংলার অন্যান্য স্থানের চেয়ে এই আকাঙÿা (গান-বাজনার) বেশি রয়েছে এবং সময়ই তাদের আকাঙÿা অব্যাহত রেখেছে।’                                                                         – হেকিম হাবিবুর রহমান

 

‘মা, ঢাকা যাচ্ছি, ঢাকা তালের দেশ। তালগান আমার তত রপ্ত নয়। বায়না নিয়েছি যেতে হবে। মান রাখিস মা।’

– গান গাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার আগে মা কালীর কাছে ইন্দুবালার প্রার্থনা।

‘লক্ষ্মৌ শহর বিখ্যাত কণ্ঠসংগীতের জন্য, আর ঢাকা তবলা ও সেতারের জন্য। ঢাকার সেতার ও তবলা তাঁর নিজস্ব ঘরানার জন্ম দিয়েছিল।’                                                                           – আইনজীবী হৃদয়নাথ মজুমদারের স্মৃতিকথা

 

 

thumbnail

মহম্মদ  হোসেন খাঁ ১৯০৩-১৯৫৯

কুমিলস্নায় জন্ম। ১৯০৩ সালে কুমিলস্নার প্রথম উচ্চ পর্যায়ের এবং উলেস্নখযোগ্য খেয়ালিয়া ওসত্মাদ মহম্মদ হোসেন খাঁ (খসরম্ন সাহেব)। খসরম্ন ভাই নামেই তিনি অবিভক্ত বাংলার উচ্চাঙ্গসংগীত মহলে পরিচিত ও বিখ্যাত ছিলেন। ওসত্মাদ মেহেদী হুসেন খাঁ, ওসত্মাদ তসদ্দুক হুসেন খাঁ, ওসত্মাদ বদল খাঁ, ওসত্মাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওসত্মাদ মুশতাক হুসেন খাঁ ও ওসত্মাদ খাদিম হুসেন খাঁর কাছে তালিম নিয়েছিলেন। খসরম্ন সাহেব প্রধানত কণ্ঠসংগীতজ্ঞ হলেও খলিফা মসিৎ খাঁর কাছে তবলার পাঠ গ্রহণ করেন। দেশভাগের পর তিনি বাংলাদেশে থেকে যান এবং ঢাকার সুপ্রতিষ্ঠিত বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর (বাফা) অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে কুমিলস্নায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ১৯৬১ সালে মরণোত্তর ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ এবং ১৯৭৮ সালে শিল্পকলা একাডেমী পদক প্রদান করা হয়।