Menu

রাগের অনুরাগে বিভোর রাত

thumbnail

সমকাল প্রতিবেদক
শুরুর সেই দিনগুলোতে কেউই চিন্তা করেননি, একই সময়ে একই স্থানে পঞ্চাশ হাজার মানুষ একত্র হবেন কেবল শুদ্ধ রাগাশ্রয়ী গান শুনতে। ২০১২ সালের প্রথম উৎসবেই সেই ধারণা পাল্টে যায়। তারপর প্রতি বছরই বেড়েছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের শ্রোতা-দর্শক। এবারও যেমনটি দেখা গেল গতকাল শুক্রবারে_ ছুটির দিনে বিকেল থেকে শুরু করে আজ ভোর অবধি গুণীশিল্পীদের রাগাশ্রয়ী পরিবেশনায় বুঁদ হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। মঞ্চে শিল্পীরা ধ্যানী ঋষি হয়ে কণ্ঠ, সুর ও সঙ্গীতের খেলায় মেতেছিলেন। দর্শক-শ্রোতারাও মগ্ন হয়ে অবগাহন করছিলেন তাতে। এভাবে গতকাল পার হলো পঞ্চম বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় দিন। সন্ধ্যালগ্নে রাগরাগিণীর এ খেলার সূচনা হয়, শেষ হয় নতুন প্রভাতের রাঙা আলোতে। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক।

গত রাতের আয়োজনের শুরুতেই ছিল ওডিশি নৃত্যের ঝঙ্কার। এটি পরিবেশন করেন ওডিশি নৃত্যধারার খ্যাতিমান প্রবক্তা বিদুষী মাধবী মুডগাল। উৎসবের মঞ্চে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত এ শিল্পীর সঙ্গী ছিলেন তার ভাতিঝি ও শিষ্য আরুশি মুডগাল। তিনিও ইতিমধ্যে মূলধারার নৃত্য ও উৎকর্ষে নতুন মাত্রা সংযোজন করে ঘরে তুলেছেন বিভিন্ন সম্মাননা। প্রথমেই মাধবী মুডগাল পরিবেশন করেন ‘নটরাজ’। এর পর আরুশি মুডগাল রাগ সাহানার আশ্রয়ে ‘আলহাদ’ শিরোনামের একক পরিবেশনায় তুলে আনেন আনন্দ-উচ্ছ্বাস। এর পর মাধবী মুডগাল মধ্যযুগের কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ আশ্রিত ‘অষ্টপদী’ নৃত্য পরিবেশন

করে তুলে আনেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর রাধার অমর প্রেমগাথা। এর পর আরুশি মুডগাল নৃত্য পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘হেমন্তে কোন্্ বসন্তেরই বাণী’র সঙ্গে। সবশেষে গুরু-শিষ্য মিলে পরিবেশন করেন ‘ভৈরবী পল্লবী’। পুরো আয়োজনে আবহসঙ্গীত পরিবেশন করেন মধুপ মুডগাল ও সমরজিৎ রায়। সঙ্গে ছিল বাঁশি, মৃদঙ্গ ও সেতারের মূর্ছনা।

ওডিশি নৃত্য শেষ হতে না হতেই মঞ্চে আসেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা। যাদের মধ্যে ছিলেন চিন্ময় ভৌমিক, ফাহমিদা নাজনিন সুমাইয়া, এম জে জে ভুবন, নুসরাত-ই-জাহান খুসবু, পঞ্চম স্যানাল, প্রশান্ত ভৌমিক ও সুপান্থ মজুমদার। হারমোনিয়ামে ছিলেন মিলিন্দ কুলকার্নি। তারা তিনতাল পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষক সুরেশ তালওয়ালকার মঞ্চে উঠে চমৎকার পরিবেশনার জন্য শিক্ষার্থীদের শুভকামনা জানান।

এর পর খেয়াল পরিবেশন করেন শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। রাগ বাগেশ্রীতে খেয়ালের মধ্য দিয়ে নিজের পরিবেশনা শুরু করেন তিনি। এর পর কৌশিকধ্বনিতে ঠুমরি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নিজের পরিবেশনা শেষ করেন তিনি। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত দেন প্রখ্যাত শিল্পী ইফতেখার আলম প্রধান।

এর পর রাহুল শর্মা মঞ্চে আসেন সন্তুর নিয়ে। প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতবেত্তা পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সুযোগ্য পুত্র রাহুল উওম্যাডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সঙ্গীত আয়োজনেও সন্তুর বাজিয়ে মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের। গত রাতে তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। রাগ গাবতিতে আলাপ জোড় ঝালা এবং রূপক তাল, মধ্যলয়ে এবং দ্রুত ত্রিতালে তিনটি সঙ্গীতায়োজন পরিবেশন করেন তিনি।

এর পর বাংলাদেশের শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েব ও তার দল পরিবেশন করে দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তবলায় ইফতেখার আলম প্রধান ও পাখওয়াজে সুষেন কুমার রায়। দলটি রাগ দরবারির একটি বিশেষ সঙ্গীতায়োজন পরিবেশন করে। এর পর পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবেশনায় ছিল সেতার বাদন। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়।

সেতারের সুর থামতেই কণ্ঠের মাধুর্য নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত উলহাস কশলকার। গোয়ালিয়র, জয়পুর ও আগ্রা ঘরানার ধারক ও বাহক এ শিল্পীর পরিবেশনা মুগ্ধ করে ৫০ হাজার শ্রোতা-দর্শককে। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকার।

এবারের আসরে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে ম্যান্ডোলিন। এটি পরিবেশন করেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়নপ্রাপ্ত ইউ রাজেশ। সঙ্গে বাঁশি বাজান আরেক গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড মনোনয়নপ্রাপ্ত বংশীবাদক পণ্ডিত রনু মজুমদার। তবলায় ছিলেন পণ্ডিত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবলার বোল, বাঁশি আর ম্যান্ডোলিনের সুর যখন চারপাশে সি্নগ্ধতা ছড়িয়ে থেমে যায়, তখন নতুন দিনের সূর্য উদিত হয় পূর্বাকাশে।

প্রথম দিনের মধ্যরাতের আয়োজন :গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে উৎসবমঞ্চে সরোদ বাজান ওস্তাদ আশীষ খান। শুরুতে তিনি রাগ দরবারি কানাড়ায় আলাপ জোড় ঝালা বাজিয়ে শোনান। এরপর রাগ চন্দ্রনন্দন ও মিশ্র ভৈরবী রাগ পরিবেশন করেন। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ। সরোদে ছিলেন সিরাজ আলী খান। এরপর খেয়াল যুগলবন্দি ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করেন বিদুষী অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর। অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে রাগ ললিত ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর পুরিয়া ধানেশ্রী পরিবেশন করেন একই সঙ্গে। এরপর রাগ দুর্গা পরিবেশন করেন অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে এবং সঞ্জীব অভয়ঙ্কর পরিবেশন করেন রাগ ভুপালি। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার। হারমোনিয়াম বাজান মিলিন্দ কুলকার্নি ও তন্ময় দোচাকি। রাতের শেষ প্রহরে বেহালা পরিবেশন করেন ড. এল সুব্রহ্মণ্যন। শুরুতেই তিনি রাগ ‘আদি তালম’-এ ‘কৃতি’ বাজিয়ে শোনান। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত তন্ময় বোস। এরপর তিনি ‘আদি তালম’-এ ‘মোহানাম’ ও নিজের সৃষ্টি ‘ছন্দপ্রিয়া’ পরিবেশন করেন। তার সঙ্গে ঘটমে ছিলেন টি এন রাধাকৃষ্ণান ও মৃদঙ্গমে লক্ষ্মীনারায়ণ রঘুনাথান।

আজকের আয়োজন :আজ শনিবার তৃতীয় দিনের অধিবেশনের শুরুতেই রয়েছে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী শিল্পীদের দলীয় সরোদবাদন। এরপর কর্নাটকি বাঁশি পরিবেশন করবেন কর্নাটকের বংশীবাদক শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন। কিরানা ঘরানার শিল্পী পদ্মভূষণ ড. প্রভা আত্রে পরিবেশন করবেন খেয়াল। একক তবলা পরিবেশন করবেন ফারুকাবাদ ঘরানার তবলিয়া পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ধ্রুপদ পরিবেশন করবেন পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর। সেতার পরিবেশন করবেন পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। উৎসবের তৃতীয় রজনীর শেষ আকর্ষণ ওস্তাদ রশিদ খান। তিনি পরিবেশন করবেন খেয়াল।

 

View Full Article