Menu

রাগে-অনুরাগে বাংলাদেশের অবদান – রাগসংগীতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিশ্রম্নতি

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার একজন ভূমিপুত্র হিসেবে তথা ভারতবর্ষের মানচিত্রে এক বিশেষ স্থানাধিকারী ও ইতিহাসনন্দিত বাংলার মাটিতে জন্মলাভ করতে পেরে আমি এক অপার স্বর্গীয় আনন্দের সঙ্গে নিজেকে অত্যমত্ম গর্বিত ও ধন্য মনে করি। আরো একটু আবেগঘন মুহূর্তের ছোঁয়া মিশিয়ে কবিকণ্ঠের প্রতিধ্বনি করে বলতে চাই – ‘আমার এই দেশেতেই জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি।’

রাষ্ট্রনৈতিক কারণে বাংলা আজ বিভক্ত। কিন্তু বাংলার মাটিতে যাদের জন্ম, বাংলার জল, বাংলার ফল, বাংলার শস্যদানায় যাদের শরীর ও মনের পুষ্টি সেই বাঙালি জাতি কিন্তু আত্মা ও সত্তাগতভাবে এক ও অভিন্ন বলে আমি বিশ্বাস করি। ধর্মবিশ্বাসের পথ ও প্রক্রিয়ায় কিছু তফাৎ থাকতে পারে; কিন্তু সব নদীর ধারাই যেমন সাগরে গিয়ে মেশে, তেমনি বিভিন্ন বিশ্বাসের ধারাও গিয়ে সেই এক ঈশ্বর বা আলস্ন­vহ তালার নামাঙ্কিত পরমাতমার কেনদ্রবিনদুতে গিয়ে বিলীন হয়। সেখানে ভেদ-বিভেদ বলে কিছু নেই। আমরা নরদেহের ক্ষুদ্র গ–র মধ্যে আবদ্ধ থাকি বলে সেই ভেদাভেদহীন মহামিলনের আননদঘন রূপটিকে সবসময় মনের মধ্যে ধারণ করে উঠতে পারি না এবং সেই ব্যর্থতা থেকেই ক্ষুদ্র তোমরা-আমার স্বার্থ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ি, যা কি না একটু মমতামাখা দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সহজেই এড়াতে পারি এবং ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্তি-আত্মার মধ্যে সেই পরমাত্মার স্বাদ পেতে পারি।

যাই হোক, লিখতে বসে আমি বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি, কারণ বাংলাদেশ ভূখ– ময়মনসিংহ জেলাটি হলো আমার মাতৃ ও পিতৃভূমি দুই-ই। ওখানেই আমার পিতা-পিতামহের ভিটামাটি। অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ সাব-ডিভিশনের মুশুলী গ্রামটি ছিল আমার পিতার জন্মস্থান আর মাতার গ্রামের নাম হলো মসুয়া। আমার মামার বাড়ির সীমানাপাঁচিলের ঠিক পাশের বসতবাড়িটি ছিল পৃথিবীখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পিতৃ-পিতামহ, ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক  সুকুমার রায় ও উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীদের। এই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরো একজন অমিত কীর্তিমান পৃথিবীশ্রেষ্ঠ জাদুকর পি সি সরকারও জন্মসূত্রে ময়মনসিংহেরই মানুষ।

প্রসঙ্গত বলি, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার পিতৃভূমি কোথায় ছিল। আমি যেই বলেছি ময়মনসিংহ, অমনি যেন ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতো বলে উঠেছিলেন, তাই না হলে তুমি এমন জিনিয়াস! হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত প্রশংসা শুনব বলে মন প্রস্ত্তত ছিল না, তাই একটু লজ্জাই পেয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, ময়মনসিংহ সত্যিই রত্নগর্ভা, নচেৎ পৃথিবী কি সত্যজিৎ রায় ও পি সি সরকারের মতো কীর্তিমান সমত্মান পেত! এ তো গেল একটা দিক, এরপর শিল্পকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ যে দিক অর্থাৎ সংগীত, বিশেষ করে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতের বিষয়ে বাংলাদেশ যে কত রত্ন প্রসব করেছে একটু পরে প্রসঙ্গামত্মরে তাঁদের নাম উলেস্ন­খ করব।

পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে কর্মসূত্রে আমার বসবাস কলকাতায়। এখানে থেকেই আমি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রামেত্ম তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগীত পরিবেশনের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করি। এই সূত্রে বাংলাদেশেও আমি বহুবার এসেছি। কখনো শুধুই ফিরে ফিরে দেশের মাটির স্বাদগন্ধ গায়ে মাখার উদ্দেশ্যে সপরিবারে, কখনো সংগীতশিল্পীর দল নিয়ে শুধু সংগীত পরিবেশনের উদ্দেশ্যে। এমনি করে বিগত বহু বছর ধরে আমি বাংলাদেশের সঙ্গে এক অতিনিবিড় আত্মীয়তার প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি।

শ্রদ্ধেয় আবুল খায়ের মহাশয় ও তাঁর সৃষ্ট বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

বছরখানেক হলো আমি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্ণধার আবুল খায়ের মহাশয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। মানুষটি আচার-ব্যবহারে, বেশভূষায় এতটাই সাদাসিধা ধরনের এবং প্রাথমিকভাবে স্বল্প-পরিচয়সূত্রে তাঁর শিল্পকলা-দরদি মনের যতটুকু আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল তাতেই আমি তাঁকে মনের অজ্ঞাতে কখন যে আমার বিশিষ্ট অগ্রজপ্রতিমদের মধ্যে বসিয়ে নিয়েছিলাম, টের পাইনি। তারপর এই নিরহংকার প্রচারবিমুখ মানুষটির চরিত্রমাধুর্যের বিভিন্ন দিক বিভিন্ন সময়ে আমার সামনে যত প্রকাশ পেতে থেকেছে, তাতে আমি একের পর এক মুগ্ধ যতটা হয়েছি, বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছি ততটাই। শিল্প-বাণিজ্য মহলের মানুষ হয়েও বিভিন্ন চারম্নকলার প্রতি তাঁর কী অসম্ভব টান এবং কী অপরিসীম ভালোবাসা, তার তুলনা মেলা ভার।

শিল্পপতি হিসেবে বাংলাদেশে তাঁর স্থান ও পরিচয় সর্বজনবিদিত। কিন্তু চারম্নকলা তথা বিভিন্ন আর্ট ফর্মের প্রচার-অগ্রগতি ও সংরক্ষণাদির কাজে তাঁর সবিশেষ অগ্রণী ভূমিকা এবং আর্থিক ও আমত্মরিক সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে।

আবুল খায়ের নামের এ মানুষটি এক দ্রষ্টামনের গভীরতা দিয়ে জেনেছিলেন সাহিত্য, সংগীত ও বিভিন্ন চারম্নকলার রসে বাংলার মাটি কী গভীরভাবে সিক্ত ও ফলদাত্রী। সাহিত্যে সূর্যভাস্বর প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়েছিল যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে। ময়মনসিংহের গর্ব চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ও জাদুসম্রাট পি সি সরকারের কথা তো আগেই বলেছি। এবার একটু সংগীতকারদের দিকে নজর ফেরালে দেখা যাবে, প্রায় গ্যালাক্সি-বিসত্মৃত নক্ষত্রের ভিড় বাংলা মায়ের কোলে। প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসছে, তিনি হলেন কুমিলস্ন­vর প্রবাদপ্রতিম বহুমুখী সংগীতপ্রতিভা বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। তিনি হেন কোনো সেতার-সরোদ-বেহালাদি তারের যন্ত্র এবং তবলা-পাখোয়াজাদি বাদ্যযন্ত্র ছিল না, যা দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন না। সর্বপ্রকার বাদনশৈলীতে তাঁর অনায়াস বিচরণ ছিল। শোনা যায়, দারিদ্রে্যর জন্য তিনি তাঁর অভীষ্ট গুরম্নর সান্নিধ্যে পৌঁছতে না পেরে একদিন পথে অপেক্ষা করে গুরম্নকে নিয়ে যে মোটরগাড়ি আসছিল তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। চালকের দক্ষতায় প্রাণে বেঁচে গেলেন। কিন্তু তাঁর আত্মাহুতির কারণ জানতে পেরে গুরম্ন হৃষ্টচিত্তে তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করে নিয়েছিলেন। আজ এই মহান কলাকারকে বাংলাদেশ-মাতৃকা কোলে ধারণ করেছিলেন বলেই না তাঁর অমন পৃথিবী আলো করা তিন শিষ্যকে সংগীতজগৎ উপহার পেয়েছিল – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কিংবদমিত্ম সরোদশিল্পী ওসত্মাদ আলী আকবর খাঁ এবং প্রবাদপ্রতিম সেতার শিল্পীদ্বয় রবিশঙ্কর ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই আলাউদ্দিন বাবার বড় ভাই আফতাবুদ্দিন সম্পর্কে শোনা যায়, তিনি নাকি যে-কোনো দৈর্ঘ্যের তার থেকে যেমন ইচ্ছে সুর বাজিয়ে সবাইকে অবাক করে দিতে পারতেন। আবার তাঁর ছোট ভাই আয়েত আলী খাঁ যেমন উঁচুদরের সরোদবাদক ছিলেন, তেমনি নিজ হাতে যন্ত্রটি তৈরি করে নিতেও পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ওসত্মাদ আলী আকবর খাঁ এবং পুত্র বাহাদুর খানের জন্য নিজের বাড়ির তুনগাছ কেটে তার কাঠ দিয়ে দুজনকে দুটি সরোদ বানিয়ে উপহার দিয়েছিলেন। প্রবাদপ্রতিম এই সরোদশিল্পী বাহাদুর খানের বর্তমান প্রজন্মের বিশিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সরোদশিল্পীর নাম শ্রী তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার।

এখানে ওসত্মাদ বাবা আলী আকবর খাঁর সঙ্গে আমার একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমার পরম সৌভাগ্য ­- আমার প্রথমবার আমেরিকা যাত্রায় যেমন বিশ্বশ্রেষ্ঠ তবলাবাদক ওসত্মাদ জাকির হুসেন নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে নিয়ে এসেছিলেন, তেমনি দ্বিতীয়বার যখন আমেরিকায় গান গাইতে যাই বাবা আলী আকবর খাঁ সাহেব ওইরকমভাবে নিজে গাড়ি চালিয়ে এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলেন। ওনার সানফ্রান্সিসকোর বাড়িতে আর এক বিস্ময়ের চমক অপেক্ষা করছিল। ওনার বাড়ির পাশে আলস্নাহ তালার উপাসনাঘরের পাশাপাশি সরস্বতী, কালী প্রভৃতি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি সাজানো দেখলাম। আমার  তাকিয়ে থাকা দেখে বললেন, কলাকারদের আবার জাত কিরে! প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, ওসত্মাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেব যিনি নিয়মিত নামাজ পাঠ না করে জলগ্রহণ করতেন না তাঁর সব থেকে প্রিয় গানের বন্দিশ, যা দিয়ে উনি অনুষ্ঠান শেষ করতেন তা হলো ‘হরি ওম তৎসৎ, ইয়ে মহামন্ত্র…’ আবার অন্যদিকে প–ত ভীমসেন যোশীর প্রিয়তম রাগ ছিল টোড়ি, যার গানের বন্দিশ হলো ‘আলস্ন­v জানে মওলা জানে…’। এছাড়া ভারতের সমসত্ম ঘরানার প্রায় সব কণ্ঠসংগীতশিল্পী গেয়েছেন তানরস খাঁ সাহেব-রচিত টোড়ি রাগের বিখ্যাত গান ‘অব মোরী নৈয়া পার করোগে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া…’। আমি নিজেও একই মুক্ত মনের মানুষ। আমার ‘গীতিনন্দন’ সংগীত পুসত্মকে আলস্ন­vহ তালার নামে ইসলামিক সাহিত্যের বাণী বসিয়ে বেশ কিছু গান রচনা করে একত্র-সন্নিবিষ্ট করেছি। রত্নগর্ভা বাংলাদেশের আরো কিছু কৃতী সমত্মানের নাম না বললে অপরাধ হবে। তাঁদের মধ্যে একজন রবীন্দ্রনাথের গানের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, যিনি সংগীত মহলে জর্জ বিশ্বাস নামে বেশি পরিচিত। তাঁর জন্মস্থান ছিল বরিশাল, যদিও পরে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন। এবার যাঁর কথা বলব তিনি হলেন গৌরীপুরের রাজসভাবাদক প্রখ্যাত ওসত্মাদ ইনায়েৎ খাঁ সাহেবের পুত্র সুরের বাদশাহ কিংবদন্তি সেতারবাদক ওসত্মাদ বিলায়েৎ খাঁ। তাঁর জন্ম হয়েছিল গৌরীপুরেই। বিলায়েৎ খাঁর বাদন সম্পর্কে একটা কথাই বোধহয় যথেষ্ট – যন্ত্রের কোনো ভাষা নেই বটে; কিন্তু বিলায়েৎ খাঁ সেতারে যেন গান করতেন, এমনকি সেতারে বাংলার বিভিন্ন লোকসংগীত সুরও সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজিয়ে শুনিয়েছেন। বিলায়েৎ খাঁর জন্ম উপলক্ষে গৌরীপুর ও আশপাশের আপামর অধিবাসীর নিমন্ত্রণ হয়েছিল রাজবাড়িতে। আমার বাবার মুখে শুনেছি সেই প্রীতিভোজে বাবাও নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। এত লোক খেয়েছিল, যাতে কেউ অভুক্ত ফেরত না যায় তার জন্য ভোজনান্তে সকলের আঙুলে ভোট-চিহ্নের মতো কালির দাগ দেওয়া হয়েছিল। আর এক কিংবদন্তি সরোদবাদক রাধিকামোহন মৈত্রের জন্ম হয়েছিল রাজশাহীর তালন্দে, যাঁর অগণিত ছাত্রের মধ্যে সুপন্ডিত পদ্মভূষণ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একজন শ্রেষ্ঠ সরোদশিল্পী ও গুরু। আরো অনেকের কথা মনে পড়ছে; কিন্তু রচনাটি বেশি ভারাক্রান্ত হবে ভেবে তাঁদের উলেস্নখে বিরত থাকছি।

খায়ের সাহেবের কথায় ফিরে আসি। এ বছর অর্থাৎ ২০১২-র এপ্রিল মাসে আমি কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি যেটি আমার জীবনে সংগীতের একটি তীর্থক্ষেত্রের চেয়েও বেশি কিছু, তার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শ্রদ্ধেয় মিস্টার রবি মাথুরজির সঙ্গে বাংলাদেশে যাই এবং খায়ের সাহেবের স্বপ্ন প্রকল্প ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে আইটিসি এসআরএ মিলিত হয়ে বাংলাদেশে এক বিসত্মৃত সাংগীতিক কর্মসূচিকে রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তখন এই উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাবার উদ্দেশ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মিউজিয়ামে ২৯ এপ্রিল এক বিশাল সংগীতানুষ্ঠান হয়েছিল। ওইদিন হঠাৎ ‘বন্ধ’-এর ডাক থাকায় সন্দেহ ছিল শ্রোতৃসমাবেশ নিয়ে। কিন্তু আমি মঞ্চে গান করতে উঠে অবাক হয়েছিলাম যে, হলটি কানায় কানায় পূর্ণ; শুধু তা-ই নয়, বহু মানুষ নাকি প্রবেশপত্রের অভাবে ফেরতও গিয়েছিলেন। রাগসংগীতের প্রতিও বাংলাদেশের মানুষের কী দুর্নিবার আকর্ষণ তা যেন নতুন করে অনুভব করলাম। এই অনুষ্ঠানের আগের দিন খায়ের সাহেব নিজের বাড়িতে একটি মনোজ্ঞ সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। গান শেষ করে ওনার বাড়িটি ঘুরেফিরে দেখে তো সত্মম্ভিত। ওটা কারো বাড়ি নাকি অতিসুদৃশ্য কোনো পেইন্টিং মিউজিয়াম-ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। শুধু পেইন্টিংই নয়, কথা বলে জানলাম উনি খুব উচ্চগুণমানের প্রিন্টিং (বই প্রকাশনা এবং শাড়ি বস্ত্রাদির ওপর কাজ) এবং আরো বহুবিধ মূল্যবান কর্মযজ্ঞ নিয়ে থাকেন। ওনার বহুবিধ প্রকল্পে বহু মানুষের যেমন জীবনজীবিকার সংস্থান হয়, তেমনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির পক্ষে ওনার  অবদানগুলো গোটা দেশের অর্থনীতিতে প্রাণশক্তি সঞ্চার করার পক্ষেও এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।

খায়ের সাহেব যে গভীর প্রজ্ঞা ও দৃষ্টি দিয়ে বাংলাদেশের সাংগীতিক সম্পদকে মূল্যায়ন করতে উদ্যোগী হয়েছেন তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত। কারণ বাংলাদেশ শুধু যে রাগসংগীতের প্রথিতযশা বিপুলসংখ্যক শিল্পীসাধকের জন্ম দিয়েছে তাই-ই নয়, রাগসংগীত তথা সংগীতের আরো বহু-বিভিন্ন ধারা-উপধারা সবগুলোরই উৎসমুখ যে লোকসংগীত (ফোক মিউজিক) সেটিরও বিপুল সম্পদে বাংলাদেশ ধনী। বাংলাদেশকে লোকসংগীতের মাতৃভূমি বললেই বোধহয় বেশি সঠিক হয়। এখানে বিরল প্রতিভা আববাসউদ্দীন থেকে শুরু করে বহু সাধকশিল্পী বাংলার লোকসংগীতকে এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। রাগসংগীতের ধারাসূত্র সন্ধান করতে করতে ক্রমশ গোড়ার দিকে যেতে থাকলে মূলে গিয়ে কোনো না কোনো  লোকসংগীতের সুরের সুপ্ত রূপটি ধরা পড়ে। ছোট্ট একটি উদাহরণে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। মার্গসংগীতের মধ্যে দুটি মূল রাগ ‘বিলাবল ও খামাজ’-এর জন্ম সরাসরি বাংলার লোকসংগীত থেকে। এমন আরো কত না যোগসূত্র গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে, যেগুলো স্থানামত্মরে আলোচনা করা যাবে।

পাশাপাশি আরেকটি কথাও খুব জোর দিয়ে বলা দরকার। তা হলো বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও নজরম্নলের গানের প্রচুর খ্যাতিমান শিল্পী রয়েছেন। এঁরা শুধু সুকণ্ঠের অধিকারীই নন, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশ থেকেও খ্যাতির পালক কুড়িয়ে এনে দেশের  মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এঁদের পরেও নিয়ত আরো কত না সম্ভাবনাময় শিল্পীর জন্ম হচ্ছে! উপরোক্ত আলোচনার আলোকে খায়ের সাহেবের অমত্মর্লোকটিকে আমরা আরো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি তাঁর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পেছনে গভীর দূরদৃষ্টির শক্তি। আজ কলকাতার আইটিসি এসআরএর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তিনি সংগীতকে ওপার বাংলা থেকে কিছু্ ইমপোর্ট করছেন না। অবশ্যই তাদের সহযোগিতাকে স্বাগত জানাচ্ছেন গভীর আমত্মরিকতায়, কারণ তিনি বুঝেছেন, বাংলাদেশ তার নিজস্ব সংগীত-সম্পদে ধনী কিন্তু গৃহিণী নয়। তার প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সংগীতশিক্ষা পদ্ধতিতে দক্ষ এক সুনিপুণ গৃহিণীসুলভ অভিভাবকত্ব। তাই এসআরএতে যেসব প্রবীণ গুণী শ্রেষ্ঠ সংগীতগুরম্ন আছেন তাঁরা এবং তাঁদের একদল উচ্চ প্রশিক্ষিত অগ্রগণ্য স্কলার সবাইকে নিয়ে নব কলেবরে যৌথ শক্তিসম্পন্ন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কোনায় কোনায় শহর ও প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে সম্ভাবনাময় সংগীতপিয়াসী ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করে তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে দেশজোড়া এক বৃহৎ বিপুল সাংগীতিক গোষ্ঠী গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হতে চায়।

এই সংগীতব্রত উদ্যাপনের ফলিত রূপটি পর্যায়ক্রমে আলোচনার আগে খায়ের সাহেবের কাছ থেকে শোনা ওনার ভবিষ্যৎ প্রকল্পের কিয়দংশের ইঙ্গিত পাঠকের কাছে আগাম জানিয়ে রাখার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সেটা হলো, আগামী দিনে নদীবক্ষে চলমান লঞ্চ, স্টিমারের মধ্যে সংগীতের আসর পেতে শ্রোতা সমভিব্যহারে এক একটি অভিনব সাংগীতিক যাত্রা বা মিউজিক্যাল জার্নি করার পরিকল্পনা রয়েছে খায়ের সাহেবের মনে।

খায়ের সাহেব উপস্থিত সমগ্র সংগীত প্রকল্পটির যে যে অংশ বাসত্মবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন তাতে দরকার হবে ক্রমান্বয়ে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা, যেখানে সিনিয়র সংগীতগুরম্নদের সঙ্গে জুনিয়রদেরও পারফরম্যান্স থাকবে। তারপর সংগীত কর্মশালার (ওয়ার্কশপ) আয়োজন করে খুব সহজভাবে প্রশ্নোত্তর এবং কণ্ঠে ও যন্ত্রে সংগীতের বিভিন্ন অঙ্গ গেয়ে ও বাজিয়ে সংগীতকে সর্বজনহৃদয়গ্রাহী করে তোলা। এরপর থাকবে কিছু এলাকাকে একত্র করে এক একটি বড় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা, যেখানে ছোট-বড় শ্রোতৃম-লীর সামনে সংগীত পরিবেশন করে নিজেদের আরো পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে তোলার সুযোগ হয়। এরপর খুব বড় করে বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক অনুষ্ঠান হবে, যাকে প্রকৃত অর্থে মেগা-ইভেন্ট বলা যায়। এখানে জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করানোর প্রয়াস থাকবে এবং যাতে বেশ কয়েক হাজার মানুষ একসঙ্গে বসে শুনতে পান, এমন বড় স্থান নির্বাচিত হবে। এতদুদ্দেশ্যেই খায়ের সাহেবের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রথম সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল এ বছরের ২৯ এপ্রিল ঢাকা মিউজিয়ামে। এরপর অবশ্য আমি দ্য ডেইলি স্টার-আয়োজিত অন্য একটি বড় সংগীতানুষ্ঠানে গান করি নভেম্বরের ২ তারিখে বাংলাদেশে মিরপুর ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে পাঁচ হাজারের মতো শ্রোতৃসমাবেশে স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। অধিকন্তু শুনেছি স্থানাভাবে অনেককে ফিরেও যেতে হয়েছিল। তবে এবার খায়ের সাহেবের প্রচেষ্টায় ‘বেঙ্গল আইটিসি-এসআরএ অ্যাকাডেমি ফেস্টিভ্যাল ২০১২’ শীর্ষক যে উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনটি হতে চলেছে নভেম্বরের ২৯ থেকে ডিসেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত চার দিনব্যাপী ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে, সেটি একটি ঐতিহাসিক সুপার-ডুপার মেগা ইভেন্ট হবে, কারণ এখানে একমাত্র ওসত্মাদ জাকির হুসেন ছাড়া জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক সত্মরের প্রায় সব শ্রেষ্ঠ নক্ষত্রেরই সমাবেশ ঘটবে। এর মহতী উদ্দেশ্য এই যে, উত্তরোত্তর মানুষের মনে সংগীতের মাধ্যমে এক সর্বজনীন প্রেম-প্রীতি-ঐক্য মিলনের বাণী সঞ্চারিত হোক এবং বাংলাদেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও সংগীতপ্রেমী মানুষের মধ্যে বিশ্বসংগীত তথা বিশ্বমানবিকতার তথা জাতীয়তার ঊর্ধ্বে এক মহৎ আমত্মর্জাতিক মধুর মিলন সম্পর্কের মেলবন্ধ সৃষ্টি হোক।

এ সবকিছু আবুল খায়ের সাহেবের স্বপ্ন বলে জেনেছি এবং হৃদয়ের অমত্মসত্মল থেকে মেনেছি। আইটিসি এসআরএর একজন দায়িত্বশীল গুরম্ন হিসেবে তাই সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা, আবুল খায়েরজির এ-স্বপ্নপ্রকল্প যেন দিনে দিনে মধুর গতিময়তার ছন্দে অচিরেই বাংলাদেশের সংগীত সম্পদকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে পারে।

thumbnail

কালে খাঁ
ওসত্মাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর (১৯০২-১৯৬৮) চাচা পাঞ্জাবের ভারতবিখ্যাত প্রবাদপুরুষ খেয়ালিয়া-বীণকার কালে খাঁ ঢাকার কলুটোলায় থাকতেন এবং মুরাপাড়ার জমিদারের দরবারে তিনি সভাগায়ক হিসেবে ঢাকায় ছয়-সাত বছর অতিবাহিত করেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁর পরিবার তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইলে তিনি যেতে রাজি হননি। ঢাকার সাংগীতিক পরিবেশ তাঁর খুবই ভালো লেগেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘মেরা মুলুক মে কদরদান রইস্ আদমি কাঁহা হ্যায়। ঢাকাহি মেরে লিয়ে আচ্ছা হ্যায়।’

thumbnail

কেরামতুল্লাহ খাঁ ১৯১৭-১৯৭৭
ফররুকাবাদ ঘরানার তবলা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাদনশৈলী। এই ঘরের শ্রেষ্ঠ তবলিয়া মসিৎ খাঁ ও তাঁর পুত্র কেরামতুল্ল­াহ খাঁ এই শহরে দীর্ঘকাল বসবাস করেছেন। ময়মনসিংহের জমিদার শশীকান্ত মহারাজের দরবারে তিনি দীর্ঘকাল তবলা সংগত করেছিলেন। ওপরের ছবিতে মসিৎ খাঁ, কেরামতুল্লাহ খাঁ ও সাবির খাঁ। একই সঙ্গে বাজাচ্ছেন একই ঘরের তিন প্রজন্মের তিন গুণী পুরুষ।

thumbnail

প্রসন্নকুমার বণিক
প্রসন্নকুমার বণিকের জন্ম ঢাকায় এক অখ্যাত গন্ধবণিক পরিবারে ১৮৫৭ সালে। যদিও তাঁর পিতামহের বিশেষ কোনো সাংগীতিক রুচি ছিল না, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্রসন্ন ঢাকায় আগত সংগীতকারদের গান-বাজনা শুনে তাঁদের ভক্ত হয়ে ওঠেন। তখন ঢাকায় প্রায়ই প্রথিতযশা গায়ক-বাদকদের আগমন ঘটত। ঢাকার শ্রেষ্ঠ তবলা ও পাখোয়াজবাদক গৌরমোহন বসাকের কাছে তবলাবাদন শিখতে শুরু করেন। বহু গায়ক-বাদককে তিনি সংগত করেন। ইমদাদ খাঁর সঙ্গে তাঁর লড়াই এককালের বিখ্যাত ঘটনা। গৌরমোহনের অনুমতিক্রমে ও অনুরোধে মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত তবলিয়া আতা হোসেন খাঁর কাছেও তিনি তালিম নেন। তাঁর বাদনশৈলীর মিষ্টতার জন্য তিনি সর্বভারতে প্রশংসিত হন। তিনি ময়মনসিংহে আসেন রামগোপালপুরের জমিদার হরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গুরু হিসেবে।

thumbnail

কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রখ্যাত তবলাবাদক। জন্ম নারায়ণগঞ্জের মুরাপাড়া গ্রামে। প্রথমে খোলবাদনে দক্ষতা লাভ, পরে যথাক্রমে প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ যদুনাথ দাস ও ভগবান দাসের কাছে সেতারে তালিম নেন। তবলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেতার ছেড়ে তবলায় তালিম নিতে মুর্শিদাবাদের ওসত্মাদ আতা হোসেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কিছুদিন দিলিস্ন ঘরানার ওসত্মাদ নত্থ খানের কাছে শিক্ষা নেন। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলেন এবং বিভিন্ন সংগীত জলসায় অংশ নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। ইংরেজি সাহিত্যে সণাতকোত্তর শ্রেণী পর্যমত্ম পড়াশোনা করেন। পা–ত্য ও গুণাবলির স্বীকৃতিস্বরূপ ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি দেন। ১৯৩০-৪৫ সাল পর্যমত্ম ঢাকার বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন।