রাগ প্রভাতীর আবাহনে সাঙ্গ হলো মহোৎসব
হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিতে রাগ প্রভাতী আর ফোক ধুনে পর্দা নামল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের পঞ্চম আসরের।
সোমবার এ উৎসবের সমাপনী রাতে বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম ছিল সংগীতপ্রেমীদের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ। রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছিল মানুষ।সব শিল্পীর পরিবেশনা শেষে প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া যখন মঞ্চে এলেন, মঙ্গলবারের সূর্য উঁকি দিতে তখন সামান্যই বাকি। হাজারো দর্শক-শ্রোতার করতালির মধ্যে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে কিংবদন্তি এই শিল্পী আর্মি স্টেডিয়ামে ছড়িয়ে দেন সুরের ইন্দ্রজাল।
বাঁশিতে রাগ প্রভাতী ও রাগ জৈৎ বাজিয়ে শোনান চৌরাসিয়া। তারপর ফোক ধুন বাজিয়ে শেষ করেন তার পরিবেশনা।
তার সঙ্গে তবলায় তাল দেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। পাখাওয়াজে ছিলেন প-িত ভবানী শঙ্কর। বাঁশি বাজিয়ে শিল্পীকে সহযোগিতা করেন দেবপ্রিয় রণদীপ ও বিবেক সোনার; তানপুরায় ছিলেন অভিজিৎ কুণ্ড।
বেনারসের পণ্ডিত রাজা রামের কাছে কণ্ঠসংগীতের তালিম নিতে গিয়েছিলেন হরিপ্রসাদ। সেখানেই একদিন পণ্ডিত ভোলানাথের বাঁশি শুনে বিমোহিত হয়ে পড়েন, ঘুরে যায় জীবনের মোড়। তার বাঁশিবাদন শিখলেন, স্থান করে নিলেন ইতিহাসের পাতায়।
দীর্ঘ সংগীত জীবনে ভারত সরকারের ‘পদ্মবিভূষণ’, ডাচ রাজপরিবারের ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ নাসাউ’ এবং ফরাসি সরকারের ‘নাইট অব দ্য অর্ডারস অব আর্ট লেটার্স’ পেয়েছেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া। তিনি এখন রটারডাম মিউজিক কনজারভেটরির ওয়ার্ল্ড মিউজিক বিভাগের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর।
উৎসবের পঞ্চম ও শেষদিনের আসর শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের পরিবেশনায়। সমবেত কণ্ঠে রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন তারা। এরপর বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করেন দলীয় সেতার। সেতার, তবলা ও গিটারের সম্মিলিত সুরে তারা রাগ চারুকেশী পরিবেশন করেন।
দিনের তৃতীয় পরিবেশনা ছিল প-িত শিবকুমার শর্মার। তিনি সন্তুরে রাগ যোগ বাজিয়ে শোনান। তার পরের পরিবেশনায় খেয়াল শুনিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন কুমার মারদুর। তিনি পুরিয়া কল্যাণ ও কিরওয়ানিতে ভজন পরিবেশন করেন।
খেয়ালের পর সেতার পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত কুশল দাস। সেতারের তারে ‘কৌশি কানাড়া’ রাগ তোলেন তিনি। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাতের সপ্তম পরিবেশনায় দর্শকদের খেয়ালে মুগ্ধ করেন আরতী আঙ্কালিকর। তাকে তবলায় সঙ্গ দেন রোহিত মজুমদার। প্রথমে তিনি রাগ যোগ কোষ পরিবেশন করেন। পরে ‘সাজনা ক্যায়সে মে আয়ু তেরে পাস’ গানে মিশ্র খাম্বাজে পরিবেশন করেন ঠুমরী।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সমাপনী দিনে এসেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, অধ?্যাপক আনিসুজ্জামান, ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন, শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদ।
উচ্চাঙ্গসংগীতের এবারের আসরটি উৎসর্গ করা হয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতির উদ্দেশে।
দুয়ারে এসে ফিরে যাওয়ার কষ্ট শেষ আসরে গান শুনতে এসেছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। জানালেন, ধ্রুপদ সংগীত তার খুব প্রিয়। চৌরাশিয়ার বাঁশি শুনতে এসেছেন। সার্বিক আয়োজন তার ভালোই লেগেছে।
গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর বলেন, ‘ঢাকার মতো অস্থির একটি শহরে এই উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব একটি আবেদন তৈরি করে, রুচি তৈরি করে, শুদ্ধ সংগীতের প্রসারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। প্রথম থেকে এ আয়োজন যেভাবে সাড়া ফেলেছিল, দিনে দিনে তা তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে গেছে, এটা খুবই ভালো লক্ষণ।’
অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রতি বছরই দেখছি তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। যদি এই অংশগ্রহণ সংগীতকে ভালোবেসে হয়ে থাকে, তবে আামাদের দেশের জন্য অনেক বড় লাভ আছে।’
উৎসবের শেষ রাত বলে দর্শকের ভিড়ও ছিল এদিন বেশি। নিয়মানুযায়ী রাত ১১টায় যখন স্টেডিয়ামের প্রবেশ পথ বন্ধ হলো, তখনো বহু দর্শক লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বনানী কবরস্থান পর্যন্ত। গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন তাদের অনেকে।
সালাউদ্দিন আহমেদ নামে এক তরুণ দর্শক বলেন, ‘আজ রাতে শেষ আসর, নিয়ম শিথিল করতে পারত। নিরাপত্তা আরও জোরদার করে আমাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারত। কর্মব্যস্ত নাগরিকদের কথা ভেবে প্রবেশের সময়সীমাও বাড়াতে পারত।’
অভিনেতা তারিক আনাম খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম প্রায় এক ঘণ্টা। আরও অপেক্ষা করলে দেড় ঘণ্টা লেগে যেত, হয়তোবা ঢুকতেই পারতাম না। অগত্যা চলে এসেছি।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিলা তাবাসসুম বলেন, ‘এত কষ্ট করে এলাম, কিন্তু ঢুকতেই পারলাম না। কী আর করা! চৌরাশিয়ার বাঁশি শোনা হলো না। জানি না, পরের বছর আর সুযোগ পাব কি না।’ সানিডেল স্কুলের শিক্ষক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জিনাত ফেরদৌস বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার মাঠে স্ক্রিনের সংখ্যা কম। এদিকটা বাদ দিলে পুরো আয়োজন ত্রুটিহীন। প্রতি বছরই আসতে চাই, এই আয়োজন আরও সাড়া ফেলুক।’
যারা পারফর্ম করলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল নৃত?্যনন্দনের ‘রবি করোজ্জ্বল’ শীর্ষক সম্মিলিত পরিবেশনায় গত বৃহস্পতিবার শুরু হয় উৎসবের প্রথম দিনের সাংস্কৃতিক পর্ব। প্রথম দিন সন্ধ্যায় আরও ছিল বংশীবাদক প্রবীণ গোদখি-ি, বেহালাবাদক রাতিশ টাগডে, তবলাবাদক রামদাস পালসুলের যুগল পরিবেশনা। পারফর্ম করেছেন সেনিয়া ও বেনারস ঘরানার প্রবাদপ্রতীম কণ্ঠশিল্পী বিদূষী গিরিজা দেবী, ভারতীয় রাগসংগীতের কিংবদন্তি আলাউদ্দিন খাঁর দৌহিত্র সরোদবাদক ওস্তাদ আশিষ খান, তবলার প-িত বিক্রম ঘোষ, জয়পুর আত্রৌলি ঘরানার প-িত অশ্বিনী ভিদে দেশপা-েম, প-িত সঞ্জীব অভয়ংকর, তবলায় আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার।
দ্বিতীয় দিনের আসরে পারফর্ম করেন ওড়িশি নৃত্যশিল্পী বিদূষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগাল, বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ, সন্তুর বাদক রাহুল শর্মা, সেতার পণ্ডিত পূর্বায়ণ চট্টোপাধ?্যায়, খেয়ালিয়া পণ্ডিত উল্লাস কশলকার, বংশীবাদক প-িত রনু মজুমদার।
বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত পরিবেশনায় শুরু হয়?তৃতীয় দিনের আসর। সেদিন পারফর্ম করেন কর্নাটকি সংগীতরীতির বংশীবাদক শশাঙ্ক সুব্রামনিয়াম, তবলা পণ্ডিত অনিন্দ?্য চট্টোপাধ?্যায়, রোহিত মজুমদার, ধ্রুপদ সংগীতের ডাগর ঘরানার ওস্তাদ উদয় ভাওয়ালকার, সেতারের সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ?্যায়, খেয়ালিয়া ওস্তাদ রাশিদ খান।
চতুর্থ দিনের পরিবেশনায় ছিলেন বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ, খেয়ালিয়া জয়তীর্থ মেউ-ি, তবলা প-িত যোগেশ শামসি ও প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ?্যায়, কর্নাটকি সংগীতের দুই কিংবদন্তি রঞ্জনী ও গায়ত্রী সুব্রামনিয়াম। ছিলেন সেতার পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী।