Menu

শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব ভাঙল সুরের মেলা

thumbnail

রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে গতকাল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সমাপনী রজনীতে মনোমুগ্ধকর সন্তুর বাজিয়ে দর্শকদের মন জয় করেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। ছবি : লুৎফর রহমান
সংগীতপিপাসুদের তৃষ্ণা তবু থেকেই গেল। পাঁচ দিনের আয়োজন, তার পরও অনেককে বলতে শোনা গেল নিমেষেই শেষ হয়ে গেল! বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের পঞ্চম আসরের শেষ রজনী ছিল গতকাল সোমবার। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে উপমহাদেশের বৃহত্তম এ আসরের জন্য আবারও শুরু এক বছরের অপেক্ষা। শেষ রজনীতে শ্রোতাদের মন মজেছে জীবন্ত কিংবদন্তি পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের সুমধুর সুর আর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে। রাতজাগা উত্সুক শ্রোতাদের নির্মল আনন্দে ভাসিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের এই দুই দিকপাল সমাপনী রাতটিকে স্মরণীয় করে রাখলেন।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এবং স্কয়ার নিবেদিত পাঁচ দিনের এ উৎসবে মোহাবিষ্ট কণ্ঠসংগীতের সঙ্গে ঝংকার তুলেছে সেতার, সরোদ, সন্তুর, তবলা, ম্যান্ডোলিন ও মধুময় বাঁশির সুর কিংবা উচ্চাঙ্গের অপরূপ নৃত্যশৈলী। জগেজাড়া খ্যাতিসম্পন্ন যে শিল্পীরা এসেছেন—আসর আয়োজন, পরিবেশ ও দর্শকদের নিয়ে সবাই ছিলেন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল, এর ফলে এই সুবিশাল আয়োজন নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই শেষ হলো শুদ্ধ সংগীতের এ মহামিলনমেলা। জয় হলো অবিনাশী সুর আর সংগীতের। জয় হলো বিশুদ্ধতার।

দেশের উদীয়মান শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীদের কণ্ঠসংগীত ও সেতারের সুরে শুরু হয় সমাপনী রাতের আয়োজন। সম্মেলক কণ্ঠসংগীত উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিল্পীরা। রাগ ভূপালির আশ্রয়ে দলীয় কণ্ঠসংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁদের পরিবেশনা। তবলায় ছিলেন বাংলাদেশের তবলিয়া মো. জাকির হোসেন ও স্বরূপ হোসেন। এরপর দলীয় সেতারে সুরেলা শব্দধ্বনি তোলেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। নিশিত দে, সাম্মো দে, আশিষ নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিৎ মণ্ডল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টি এম সেলিম রেজা, খন্দকার নজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জি, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ, মো. কাওছার প্রমুখের বাদনশৈলী মাতিয়ে তোলে দর্শক-শ্রোতাদের। তাঁদের পরিবেশনার পর ছিল সমাপনী অনুষ্ঠান।

সমাপনী আনুষ্ঠানিকতায় প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান।

অন্য যেকোনো দিনের তুলনায় এ রাতের আসর জমে ওঠে মধ্যরাতের আগেই। সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে না হতেই সবাই নিবিষ্ট মনে আসন পেতে বসে। আগ্রহের কেন্দ্রে তখন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। সংগীতজগতে সন্তুর শব্দটির সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে; একনিষ্ঠ অধ্যবসায়, ক্লান্তিহীন গবেষণা ও পুনঃপুন বিনির্মাণের মাধ্যমে সন্তুরবাদনে যিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন, কাশ্মীরি লোকসংগীতে ব্যবহৃত সন্তুরকে উপস্থাপন করেন মার্গসংগীতের মঞ্চে। হৃদয় ছুঁয়ে যায় তাঁর বাদন। তাঁকে তবলায় সংগত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি।

রাত পৌনে ১০টায় লাল পাঞ্জাবি পরা শুভ্র চুলের এই সন্তুরবাদক মঞ্চে এসে সংক্ষিপ্ত কথনে বলেন, এই উৎসব এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সংগীত আসরে। আর উচ্চাঙ্গসংগীত বুঝতে হলে বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। মনঃসংযোগ দিয়ে অনুভব করলেই সহজাতভাবেই এটা ছুঁয়ে যায় শ্রোতার আত্মা। কথা শেষ করে সযত্নে দুই হাঁটুর মাঝে তুলে নেন বাদ্যযন্ত্রটি। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো চোখটি বুজে পরম মমতায় শুরু করেন বাদন। বেজে ওঠে মধুর সুর। সন্ধ্যাকালীন রাগ যোগের আশ্রয়ে ঘণ্টাব্যাপী পরিবেশনা শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়। আলাপ দিয়ে শুরু করে রূপক তাল পেরিয়ে পৌঁছে যান তিন তালের সমন্বিত কম্পোজিশনে। এমন অনবদ্য পরিবেশনায় শ্রোতার ভালো লাগার প্রকাশ ঘটে তুমুল করতালিতে। শিল্পী কখনো তবলিয়ার সঙ্গে মেতে ওঠেন সুরের খেলায়, কখনো সুরকে উচ্চতায় চড়িয়ে আবার কখনো খাদে নামিয়ে তাঁর সাবলীল বাদন বারবার ছুঁয়ে যান শ্রোতার হৃদয়। তাঁকে তবলায় সংগত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি।

মাঠ ছাড়িয়ে গ্যালারিও তখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঘড়ির কাঁটায় যখন মধ্য রাত ১২টা, তখনো প্রবেশমুখের লাইন কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়।

এরপর খেয়াল পরিবেশন করেন ভারতের ধারাওয়াড় গায়নরীতির কুশলী কণ্ঠশিল্পী কুমার মারদুর। অনবদ্য পরিবেশনায় তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করেন আজিঙ্কা যোশি। ভারতের বিশিষ্ট সেতার ও সুরবাহার শিল্পী কুশল দাস মঞ্চে এসে সেতারের সুর মূর্ছনায় বিমোহিত করেন। এরপর আবারও খেয়াল পরিবেশন করতে আসেন ভারতের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আরতি আঙ্কলিকার। তাল ও সুরের ওপর চমৎকার দখল সুকণ্ঠী এই গায়িকার পরিবেশনাকে করে তোলে মোহনীয়। তাঁকে তবলায় সংগত করেন রোহিত মজুমদার।

সব শেষে যাঁর অপেক্ষায় ছিল অগণিত ভক্ত, বাঁশির সেই জাদুকর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া আসেন মঞ্চে। কিংবদন্তি এ শিল্পীর বাঁশিতে নানা সুরের তরঙ্গ তন্ময় হয়ে উপভোগ করে শ্রোতারা। হৃদয়ছোঁয়া সুরের ভেলায় ভেসে বেড়ায় শ্রোতার মন। এক ঐন্দ্রজালিক আবহের মধ্যে আসরের যখন সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় তখন আরো কিছু সময় শুনতে না পারার আফসোস নিয়ে একে একে সবাই পা বাড়ায় নিজ নিজ গৃহের দিকে।

 

View Full Article