Menu

শুদ্ধসুরে বিনিদ্র রাত

thumbnail

 

দীপন নন্দী
প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলো_ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হলো পঞ্চম বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। আবারও রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে ঢল নামল বছরজুড়ে অপেক্ষারত সঙ্গীতপ্রেমীদের। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত পাঁচ দিনের এ উৎসবের প্রথম দিনেই ছিল এবারের আসরের সবচেয়ে বর্ষীয়ান শিল্পী বিদুষী গিরিজা দেবীর খেয়াল। আরও ছিল ড. এল সুব্রহ্মণ্যনের বেহালা, ওস্তাদ আশীষ খানের সরোদ, প্রবীণ গোদখিণ্ডির বাঁশি আর রাতিশ তাগড়ের বেহালার সুর। স্কয়ার নিবেদিত এ উৎসবে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক। এবারের আয়োজন উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে।

এবারের আসরের সূচনা হলো নৃত্যনন্দনের

শিল্পীদের সম্মেলক নৃত্য পরিবেশনের ভেতর দিয়ে। শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘রবি করোজ্জ্বল নৃত্যমালিকা’ শিরোনামের এ আয়োজনে ছিল রবীন্দ্রনৃত্যভাবনার মূর্ছনা। মণিপুরি নৃত্যশৈলীর এ পরিবেশনা মুগ্ধ করে দর্শকদের। নৃত্যের সঙ্গে পরিবেশিত গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী’, ‘বিপুল তরঙ্গ রে’ ও ‘ওই পোহাইলো তিমির রাতি’। এ ছাড়াও ছিল ব্রজবুলি ভাষার গান।

উপস্থাপনার দ্বিতীয় অংশে ছিল মণিপুরি নৃত্য। এরপর একে একে ভরতনাট্যম, প্রদীপনাচ, রাধাকৃষ্ণ, পুংচালাম, ওডিশি ও কত্থক আঙ্গিক, রবীন্দ্র নৃত্যভাবনা এবং বাংলাদেশে যে ক’টি শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রচলিত ও চর্চিত সেগুলো অবলম্বনে নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা।

২০১০ সালে আর্জেন্টিনার ওয়ার্ল্ড ফ্লুট ফেস্টিভ্যালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় উৎসবে বাঁশি বাজিয়ে খ্যাতি পেয়েছেন প্রবীণ গোদখিণ্ডি। তার বাঁশির সঙ্গে যুগলবন্দিতে ছিলেন বেহালাবাদন নিয়ে ‘ইনসিঙ্ক’ শোর স্রষ্টা ও ভারতের মিউজিশিয়ানস ফেডারেশনের সভাপতি রাতিশ তাগড়ে। তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন রামদাস পালসুল। যুগলবন্দি এ পরিবেশনার শুরুতেই ছিল রাগ মারু বিহাগ। রাগ হংসধ্বনি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ যুগলবন্দি।

এ যুগলবন্দি শেষে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অতিথি ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে আনন্দ পেতে কান তৈরি করতে হয়। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে আগ্রহী কেউ অসুন্দর কাজ করতে পারে না। এ উৎসব নিয়ে ঢাকার একটি বড় গোষ্ঠী উৎসাহী হয়ে উঠেছে, যাদের আশিভাগ তরুণ, এটি আশার কথা। আমরা এ উৎসবকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসরে পরিণত করেছি।’ ঢাকার বাইরেও এ ধরনের আয়োজন করা হবে বলে আশা করেন তিনি।

সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘এ বছর এ উৎসব হবে কী হবে না, এটা নিয়ে আমরা দ্বিধায় ছিলাম। সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এ উৎসব শুরু হলো, এটা খুব আনন্দের ব্যাপার।’ বক্তব্য শেষে তিনি গুলশান হামলার ওপরে তারিক সুজাত রচিত কবিতা ‘জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’ আবৃত্তি করে শোনান।

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘এ মঞ্চের বিশেষত্ব হলো, এতে প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান শিল্পীদের একসঙ্গে মঞ্চে আনা হয়। সংস্কৃতি দুই দেশের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের জনগণকে একমঞ্চে আনার জন্য আয়োজকদের অভিনন্দন।’

আবুল খায়ের বলেন, ‘সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার প্রতি এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আমাদের এই উৎসব। একজন মানুষ যদি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শোনে, তাহলে সে কখনও খারাপ কাজ করতে পারবে না।’

এরপর খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন বিদুষী গিরিজা দেবী। সেনিয়া ও বেনারস ঘরানার প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পীর কণ্ঠে স্তব্ধতা ও মুগ্ধতা নেমে আসে পুরো স্টেডিয়ামে। তার সঙ্গে ছিলেন তবলায় গোপাল মিশ্র ও সারাঙ্গিতে মুরাদ আলি খান। প্রথমেই তিনি পরিবেশন করেন রাগ যোগকোষ। এর পর তার কণ্ঠে শোনা যায় রাগ মিশ্র খাম্বাসে ঠুমরি। একটু থেমে টপ্পার পর আরেকটি রাগ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার পরিবেশনা।

এরপর সরোদবাদন নিয়ে মঞ্চে আসেন আলাউদ্দিন খাঁর দৌহিত্র ও আলি আকবর খাঁর পুত্র ওস্তাদ আশীষ খাঁ। গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পাওয়া এ শিল্পীর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ।

‘জাসরাঙ্গি’ শিরোনামে খেয়াল যুগলবন্দি নিয়ে এরপর মঞ্চে আসেন জয়পুর আত্রৌলি ঘরানার অন্যতম শিল্পী বিদুষী অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে ও মেওয়াতি ঘরানার প্রখ্যাত শিল্পী পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর। তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার।

গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত ড. এল সুব্রহ্মণ্যনের বেহালাবাদনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের আয়োজন। ড. এল সুব্রহ্মণ্যনের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত তন্ময় বসু। বেহালার সুরে রাজধানীতে নেমে আসে নতুন এক ভোর। সে সি্নগ্ধতাকে সঙ্গী করে ঘরে ফেরেন শ্রোতারা আর্মি স্টেডিয়াম থেকে।

আজকের আয়োজন :আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই ওডিশি নৃত্য পরিবেশন করবেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও তার শিষ্য আরুশি মুডগাল। দলীয় তবলা পরিবেশন করবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীশিল্পীরা। খেয়াল পরিবেশন করবেন বাংলাদেশের শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। সন্তুরে ঝঙ্কার তুলবেন শিল্পী রাহুল শর্মা। কণ্ঠে দলীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন মোহাম্মদ শোয়েব ও তার দল। সুর তুলবেন সেতারে রাগসঙ্গীতের স্বতন্ত্র রূপকার পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। খেয়াল পরিবেশন করবেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর। উৎসবে নতুন যুক্ত হওয়া ম্যান্ডোলিন বাদনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। সঙ্গে থাকবে বাঁশি, যা পরিবেশন করবেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড মনোনয়নপ্রাপ্ত বংশীবাদক পণ্ডিত রনু মজুমদার ও ম্যান্ডোলিনের রূপকার প্রয়াত ইউ শ্রীনিবাসের ভাই ইউ রাজেশ।

অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রয়াত শিল্পী বালমুরালি কৃষ্ণ ও ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেনকে। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের এ আসর শুরু হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পী বালমুরালি কৃষ্ণ।

View Full Article