Menu

শুদ্ধ সংগীতের মূর্ছনায়

thumbnail

সংগীতের এক আলাদা শক্তি রয়েছে। এর ধ্বনি, সুর, তাল, লয় প্রাণকে উজ্জীবিত করে। প্রশান্তি দেয়। অনেক সময় চেতনাকে শাণিত করে। কাল থেকে কালান্তরে সংগীতের সুধায় আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ অন্য রকম স্বস্তি ও স্বাদ লাভ করে আসছে। যারা সংগীতের সমঝদার, তাদের কাছে এর অবদান অনেক। বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সংগীতের যে গভীর আবেদন, তা বুঝে উঠতে পারলে নতুন এক জগৎ খুলে যায়। সংগীতের তেমন সমঝদার আর কয়জন! তবে স্বীকার করতে হবে বাংলাদেশের মানুষ সংগীত অনুরাগী। তারা সংগীতের মূর্ছনায় ভেসে যেতে পারে। সংগীতে আন্দোলিত হওয়ার মতো মানসিক আগ্রহ তাদের রয়েছে। সংগীতের কারিগরি দিক বা তাল-লয়ের খেলা না বুঝেও শিল্পীর পরিবেশনার নৈপুণ্য, কণ্ঠের আহরণ-অবরোহণ দেখে মুগ্ধ হয়। তবলার বাজনার মধ্যে যে মাদকতা, যে দ্রুতলয় ও ভাঙচুর থাকতে পারে, তা যে কেউ দেখে মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধতার জন্য সংগীতের বিদ্যা থাকার প্রয়োজন পড়ে না। মননশীলতার গভীর থেকেই জেগে ওঠে ভেতরের এক মানুষ।

এবার ষষ্ঠবারের মতো বেঙ্গল গ্রুপের উদ্যোগে বিশ্বে উচ্চাঙ্গসংগীতের সবচেয়ে বড় আসর বসল বাংলাদেশে। মানুষও যে দিন দিন উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতিটি শাখার প্রেমে অনুরক্ত হয়ে উঠছে, এই আয়োজনের প্রসারই তার প্রমাণ। প্রথম থেকে পঞ্চমবার পর্যন্ত আর্মি স্টেডিয়ামে বসে এই আসর। আমি দেখেছি এর নানা রকমের দর্শক গ্রুপ রয়েছে। কেউ সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত, কেউ রাত ১০টা থেকে দু-তিন ঘণ্টা, কেউ মধ্যরাত থেকে একেবারে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত। এক শ্রেণির দর্শক থাকে, যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উপভোগ করে আয়োজনের প্রতিটি পরিবেশনা। আমন্ত্রিত ও বিশিষ্ট অতিথিরা সন্ধ্যা থেকেই আসতে শুরু করেন। আর জনসাধারণ, যারা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে প্রবেশের পাস সংগ্রহ করেছে তারা সুবিধামতো আসে। রাত যত বাড়ে তত যেন দর্শকদের মগ্নতা বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই রাত বাড়লে চারদিকে নীরবতা বাড়ে। এই নীরবতায় দর্শকরা উচ্চাঙ্গের তাল-লয়ের অদ্ভুত জগতে ঢুকে যায়। এবার ষষ্ঠবার এই আয়োজন হলো ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে। জায়গাটি দর্শকদের জন্য বেশ সুবিধাজনক মনে হয়েছে; যদিও ধানমণ্ডির আবাসিক এলাকার মধ্যেই এই আয়োজন, তার পরও নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও আয়োজনের শৃঙ্খলা রক্ষার নানা ধরনের প্রস্তুতি দর্শকদের বেশ উচ্ছ্বসিত করেছে। বিশেষ করে, প্রবেশের ক্ষেত্রে দর্শকরা মোটেই কোনো বিড়ম্বনার শিকার হয়নি। ব্যবস্থাপনার দূরদর্শিতার কারণেই যেকোনো বয়সের মানুষকে বিনা মূল্যে উপভোগ করার আন্তর্জাতিক মানের এই সংগীতের আসর এক অন্য রকম আমেজ উপহার দিয়েছে। দিন যত যাচ্ছে ততই এই আয়োজন পরিচ্ছন্ন ও সুগঠিত হয়ে উঠছে। আয়োজকদের সারা বছরের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার দক্ষতাই এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রতিবছরই মানুষের উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে। উচ্চমার্গীয় পরিবেশনার ভেতরে দর্শকরা পিনপতন নীরবতায় উপভোগ করেছে মূর্ছনা। এই মগ্ন দর্শকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তার মানে বলাই যায়, এ রকম একটি আয়োজন অনেক দর্শককে টানছে সংগীতের গভীর জগতে। এটি অনেক ভালো দিক। শুরুর দিন থেকেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অতিথি থেকে শুরু করে অনেকেই যে কথাটি বলতে চেয়েছেন, সুন্দরের প্রতি মানুষের অভিনিবেশ বৃদ্ধি পাওয়া অনেক বড় একটি ইতিবাচক দিক। এটি আমাদের দেশের জন্য ভালো, গণমানুষের জন্য ভালো। সামগ্রিকভাবেই কল্যাণকর।

আমি অনেক আগে থেকেই জানি বেঙ্গল গ্রুপের কর্ণধার আবুল খায়ের লিটু সামগ্রিকভাবে পরিশীলিত এক শিল্পমনা মানুষ। তাঁর প্রতিটি কাজে সৃজনশীলতা রয়েছে। তাঁর চিন্তার মধ্যে রয়েছে দেশীয় সংস্কৃতির উৎকর্ষ ও বিশ্বায়নের  সঙ্গে আমাদের সৃজনশীলতার যোগসূত্র স্থাপন। পারিবারিকভাবেই তিনি শিল্প অনুরাগী হলেও তাঁর পদক্ষেপের সাহসিকতা এবং উদ্যোগের উদারতা আমাদের সব সময় আশান্বিত করে। কয়েক মাস আগে যখন আর্মি স্টেডিয়ামে এবারের উৎসব আয়োজনের অনুমতি পেলেন না তখন সংবাদ সম্মেলনে তাঁর অশ্রুসজল বক্তব্য শুনে অবাক হয়েছি। কতটা শিল্পপ্রাণ হলে দেশের মানুষের প্রিয় এই আয়োজনের জন্য একজন উদ্যোক্তার অন্তর কেঁদে ওঠে। তাঁর মধ্যে প্রত্যয় ছিল বলেই তিনি ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে এই মাঠে এমন আয়োজনকে সম্ভবপর করতে পারলেন। দর্শক জেনেছে, ওই মাঠে মৌসুমি অনুশীলনসহ গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট চলছিল; যেগুলো অন্যত্র ব্যবস্থা করে আয়োজনটি করা হয়। এ ক্ষেত্রে আবাহনী ক্রীড়াচক্র কর্তৃপক্ষেরও যথার্থ আন্তরিকতা ছিল। মাঠটি অনেক বড় হওয়ায় এখানে উচ্চাঙ্গসংগীত আসরের সব রকমের ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সুন্দরভাবে গোছানো সম্ভব হয়েছে। উৎসব জমানোর জন্য স্টলসহ স্থাপনাগুলো সুন্দরভাবে করা সম্ভব হয়েছে, যা কোনোভাবেই সংগীতের মূলমঞ্চের মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। অন্যদিকে এবারের আয়োজনে আধুনিক শব্দযন্ত্রের সন্নিবেশ ছিল। এর কারণে অনুষ্ঠানের শব্দ মাঠের বাইরে বের হতে পারেনি অর্থাৎ মাঠের চারপাশের বসতির মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেনি। এগুলো এমন একটি আয়োজনের উৎকর্ষের দিক। এ ছাড়া দর্শকদের বসার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনার প্রতিটি কাজের মধ্যেই আলাদা এক নৈপুণ্য ছিল। এতে সাধারণ দর্শকও সম্মানিত বোধ করেছে, পাশাপাশি প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে পেরেছে এই আয়োজন।

এ বছর চ্যানেল আই এই আয়োজনের ব্রডকাস্ট পার্টনার, তাই প্রতি রাতেই আমি আর সাগর (ফরিদুর রেজা সাগর) গিয়েছি। যেতে হয়েছে বলা যায়। এর মধ্য দিয়ে চ্যানেল আইয়ের ব্রডকাস্ট দেখভাল করার পাশাপাশি নিয়মিত উপভোগ করেছি মুগ্ধ শ্রোতার মতো। আমি বিস্মিত হয়েছি আমাদের দেশের কিছু সংগীত সমঝদার দেখে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বপ্রথম বলতে হবে আবুল খায়ের লিটু ভাইয়ের মায়ের কথা। তিনি প্রতিদিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পরিবেশনা তন্ময় হয়ে উপভোগ করেছেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও প্রতিদিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর উপস্থিতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন সংগীতের শক্তি তিনি গ্রহণ করতে জানেন। ৮৩ বছর বয়সে তাঁর এই আত্মশক্তি আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর প্রথম দিনের উদ্বোধনী বক্তব্যেও বিষয়টি বুঝেছিলাম। এই আয়োজনের জন্য একটি বিশেষ জায়গার স্থায়ী ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাঁর আন্তরিক অঙ্গীকার সব দর্শককেই মুগ্ধ করেছে। এর পাশাপাশি তিনি যে বিষয়টি তুলে ধরেন, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের একটি ‘জাতীয় অর্কেস্ট্রা’ প্রয়োজন, যেটি আমাদের নেই; কিন্তু থাকা উচিত। সমঝদার বলেই তিনি চিন্তাটি করতে পেরেছেন। তাঁর এ কথাও সব দর্শক পছন্দ করেছে। এই চিন্তা হয়তো অনেকের মাথায় ছিল না। তিনি উত্থাপন করে আমাদের সংগীতাঙ্গনের দায়িত্বশীল ও খ্যাতি ব্যক্তিদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের আরো অনেক মুগ্ধ দর্শককে দেখেছি। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, খুশী কবির, সুলতানা কামাল, তপন চৌধুরীসহ আরো চেনা-জানা অনেকেই গভীর অনুরাগ ঢেলে উচ্চাঙ্গসংগীত উপভোগ করেছেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশের বিভিন্ন দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তা, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পীরা গভীর রাত পর্যন্ত সুরের মূর্ছনায় ডুবে থেকেছেন। বিশ্বাস করি যাঁরা রুচিশীল, যাঁরা সৃষ্টিশীল তাঁরাই এমন আয়োজনে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেছেন। যাঁরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি, তাঁরা চ্যানেল আইয়ে উপভোগ করেছেন। চ্যানেল আই ছয়টি মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা দর্শকদের স্বার্থে ভোর পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এ ছাড়া আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, প্রবাস থেকে অনেক বাংলাদেশি শুধু এই উৎসবে যোগ দিতে সময় বের করে দেশে চলে এসেছেন এবং অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। এটি অনেক বড় নজির।

বারবার এই শহরে শীতের আমেজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে জমে উঠুক বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীতের এই আন্তর্জাতিক আসর। শুদ্ধ সংগীতের মূর্ছনায় মানুষ শুদ্ধতার চর্চায় মনোনিবেশ করুক। সমাজ থেকে দূর হয়ে যাক নেতিবাচক সব কিছু।

 

View Full Article