Menu

শেষ হল উৎসব চৌরাসিয়ার বাঁশি শিবকুমারের সন্তুরে মোহনীয়তা

সুরের জাদুতে মোহনীয়তা ছড়িয়ে দিলেন তারা। একজন বাঁশির জাদুকর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। আরেকজন সন্তুরের মধুরতা ছড়ানো শিল্পী পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। তাদের সুরের মোহময়তায় রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে নেমে এসেছিল স্বর্গীয় আবেশ। উৎসরেব সমাপনী রজনীতে দুই দিকপালের সঙ্গীত পরিবেশনা। যেন তাদের জন্যই সবার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সে ক্ষণ হাজির হল সোমবার রাতে। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের সমাপনী রাতের তৃতীয় শিল্পী ছিলেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। স্টেজে এসে সবার উদ্দেশে বললেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বুঝতে হলে বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। মনোসংযোগ দিয়ে অনুভব করলেই সহজাতভাবেই এটা ছুঁয়ে যাবে আত্মাকে। কথা শেষ করেই সন্তুরের তারে তারে তিনি ঝরিয়েছেন সুমিষ্ট সুরের ধারা। তাতে মন যেন হারিয়ে যায় অন্য কোথাও। সান্ধ্যকালীন রাগ যোগের আশ্রয়ে রাঙিয়ে দেন শ্রোতার মন। আলাপ দিয়ে শুরু করে রূপক তাল পেরিয়ে পৌঁছে যান তিন তালে। সবশেষে পাহাড়িয়া ধুন বাজিয়ে নিসর্গকে যেন ছবির মতো সামনে নিয়ে আসেন। আর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি বেজেছে সবার শেষে। সে বাঁশির সুরে আন্দোলিত হয়েছে তনুমন। হাজারো মানুষের হৃদয়কূলে তা আছড়ে পড়েছে প্রতিটি ক্ষণে। মন্ত্রমুগ্ধ করা সে বাঁশি যতই শুনা হয় মন যেন আর ভরে না। সুরের সে পরশকে সঙ্গী করেই আসর ভাঙল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের এবারের আয়োজনের।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গিত এবারের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের শুরুটা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। এক রাত দু’রাত করে সুরের লহরীতে ভাসতে ভাসতেই সোমবার চলে এসেছিল উৎসবের শেষ রজনী। আর রাত জেগে সঙ্গীত উপভোগ করার কান ঢাকার শ্রোতাদের তৈরি হয়েছিল আরও আগেই। সঙ্গে যুক্ত হল এবারের আসরের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা এবং বহুমাত্রিক আয়োজন।
উৎসবে সমাপনী ও পঞ্চমদিন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি ও পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের পরিবেশনা ছাড়াও দলীয় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। কুমার মারদুর শোনান খেয়াল। সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। খেয়াল পরিবেশন করেন আরতী অঙ্কালিকার। সমাপনী দিনের পরিবেশনার শুরুতেই কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। সমবেত কণ্ঠে তারা রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন মো. জাকির হোসেন ও স্বরূপ হোসেন।
দলীয় সেতার বাজিয়ে শোনান বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা পরিবেশন করেন চারুকেশী। নিশিত দে, সাম্মো দে, আশিশ নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিৎ মণ্ডল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টিএম সেলিম রেজা, খন্দকার নজমুস সাকিব, রিংকুচন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যাতি ব্যার্নাজি, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবন, মো. কাওছার প্রমুখের বাদনশৈলী মাতিয়ে রাখে দর্শক-শ্রোতাদের। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দেশের শিল্পীরাও যে এগিয়ে যাচ্ছেন তার স্বাক্ষর রাখেন শিল্পীরা। দেশের শিল্পীদের এই দুই পরিবেশনার পরেই ছিল উৎসবের সমাপনী ঘোষণার আয়োজন। অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার বক্তব্যের শুরুতে সৈয়দ শামসুল হককে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্তে শুদ্ধ সংগীতের ধারা বইছে। এই ভূখণ্ড থেকে এক সময় ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবি শংকরের মতো শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এ উৎসব চলমান থাকলে পুনরায় আমরা বিশ্বমানের শিল্পী পাব।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা যখন স্তিমিত হতে যাচ্ছিল তখন এ উৎসব সে চর্চাকে আবার উজ্জীবিত করেছে। যা আমাদের জাতীয় চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’ মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘শিল্পীরা পারেন একটি দেশের মননে পরিবর্তন আনতে। তাই তাদের যথাযোগ্য সম্মান যেন আমরা দেই।’ মেয়র সাঈদ খোকন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পুরান ঢাকার ১২টি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনার ভার নিতে তাকে অনুরোধ করেন এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য করারও আশ্বাস দেন। অঞ্জন চৌধুরী উৎসবের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘ভবিষ্যতে অন্যান্য আরও বড় উৎসব আমরা আপনাদের উপহার দেব।’ আবুল খায়ের সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যেন দেশে কমপক্ষে তিন হাজার সিনেমা হল তৈরি করে দেয়া হয়। বক্তব্যের শেষে তিনি আসছে জানুয়ারি মাসে তিন রাত ধরে সুফি গানের উৎসব করার ঘোষণা দেন। সমাপনী আয়োজন শেষে মঞ্চে আসেন এবারের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। তার সন্তুরের অপূর্ব পরিবেশনা শেষে খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন কুমার মারদুর। সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত কুশল দাস। সেতারের তারে তারে তিনি সুরের ধারা বইয়ে দেন। পণ্ডিত কুশল দাসের পর খেয়াল পরিবেশেন করেন আরতি অঙ্কালিকার। তবলায় তাকে সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার জাদুকরী বাঁশির সুরে সুরে শেষ হয় এ উৎসব। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের এবারের আসর নিবেদন করেছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় ছিল ব্র্যাক ব্যাংক।