Menu

সারা রাত শুধু চৌরাসিয়ার বাঁশিবন্দনা

দিনজাগানিয়া সূর্যটাকে তিনি নিজের করে নিয়েছেন বহু আগেই। তার বাঁশির সুর সূর্য আর পৃথিবী-বিষয়ক সূত্রটাকেও যেন উল্টে দিয়েছে। এ শহরের মানুষ এত দিনে জেনে গেছে, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া নামের একজন বাঁশিবাদক আছেন, যিনি চাইলেই প্রকাণ্ড সূর্যটাকে নিয়ে আসতে পারেন পৃথিবীর বুকে। এ শহরের মানুষের মনে এই বিশ্বাসও ভর করেছে যে, বরাবরের মতো এবারো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের সমাপনী রাতকে চৌরাসিয়া বধ করবেন তার বাঁশির মুগ্ধতা ছড়িয়ে।
রাত ১১টা ৫০, সোমবার, আর্মি স্টেডিয়াম। ঠিক ১০ মিনিট পর বন্ধ হয়ে যাবে উৎসবস্থলে ঢোকার প্রধান ফটক। রাজধানীর বনানীর রাস্তার দু’পাশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মানুষ। চোখের অনুমান, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এ মানুষের সংখ্যা আর তাদের উৎসাহ ঢের বেশি। এত কোলাহলের মধ্যেই চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক প্রশ্ন করে, ‘আজ এত মানুষ কেন?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আজ যে চৌরাসিয়ার রাত। আজ তার বাঁশির সুরে ভোর হওয়া দেখবে মানুষ।’ ভিড় ঠেলে যত এগোনো হলো, ততই হরিপ্রসাদ-বন্দনা ভেসে আসতে লাগল।

কজন মানুষ বাঁশি বাজাবেন, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তার বাঁশির সুর শুনবেন— এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এত আগ্রহ, এত বেশি কৌতূহল! শুধু তা-ই নয়, সমাপনী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থীদের দলীয় কণ্ঠসংগীত, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের দলীয় সেতার পরিবেশনা, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুর, কুমার মারদুরের খেয়াল, পণ্ডিত কুশল দাসের সেতার, আরতি আঙ্কালিকারের খেয়াল যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল, তাতে অন্তত এ দর্শনার্থীদের তুষ্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেখানেই কান যায়, সেখানে একটাই কথা— কখন মঞ্চে উঠবেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। রাতের প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে তিনি মঞ্চে ওঠার আগ পর্যন্ত যেন এত আয়োজনের কোনো কিছুই দর্শনার্থীদের তুষ্ট করতে পারছিল না।
রাত ৩টা ৩৫। মঞ্চে বিরাজ করছে খানিকটা অন্ধকার। এরই মধ্যে বাঁশির একটু শব্দ গেল। কে বাজাল, কার বাঁশির সুর, তা না দেখেই হ্রসধ্বনি আর উল্লাসে ফেটে পড়ল গোটা উৎসবস্থল। এর পর খানিকটা নীরবতা। ১ মিনিট বাদে একই রকম আরেকবার শব্দ এল। এবারো চারদিক থেকে নেমে এল কলরব। এর পর রাত ৩টা ৪১ মিনিটে মঞ্চ নামের যুদ্ধের ময়দানে দেখা গেল সবার পরম প্রত্যাশিত শিল্পী হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াকে। বাঁশি হাতে যিনি এখনই যুদ্ধে নামবেন। এখনই এ যোদ্ধা তার জাদুকরী অস্ত্র দিয়ে বধ করবেন ঘুমজাগানিয়া মানুষের মন।
অল্পতে শুভেচ্ছা বক্তব্য শেষ করে বাঁশিটা মুখের কাছে নিয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি নতুন একটা গান বেঁধেছি। প্রভাতী…।’ দূর থেকে অস্পষ্টভাবে ভেসে আসা এমন কথার পর দুহাতে আলতো করে ধরলেন বাঁশি। শুরু হলো সূর্যকে খুঁজে ফেরার সুর। তিনি যখন বাঁশির সম্মোহনে সবাইকে মুগ্ধ করছেন, হয়তো তখন শ্রোতাদের খেয়ালও আরেকটি জায়গায় আবদ্ধ হলো। কয়েকজন শ্রোতা নিজেদের অনুভূতি জানিয়ে এও বলছিলেন, বয়স চৌরাসিয়াকে হার মানাতে শুরু করেছে। তার হাত দুটো কাঁপছিল। কখনো কখনো লম্বা সুর দিতে গিয়েও নিঃশ্বাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন তিনি। শুরুতে এমন আশঙ্কা একটা সময় গিয়ে যে চৌরাসিয়া মিথ্যায় পরিণত করবেন, তা কে জানত। তার বয়স যেন মুহূর্তেই নেমে এল ত্রিশের কোটায়। পাঁচ সঙ্গী নিয়ে সোজা হয়ে বসে থেকে যে সুর তিনি ধরলেন, তাতে মনে হলো— এই বুঝি পাখিরা ঘুম থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছে, সূর্য শুনতে পেয়েছে চৌরাসিয়ার বাঁশির সুর, হয়তো খানিকক্ষণের মধ্যেই সে নিজেও ধরণীতে এসে ধরা দেবে।
উপস্থিত শ্রোতারা হয়তো একটি বিষয় খেয়াল করেছিলেন, বাঁশি বাজাতে বাজাতে মানুষটি শিশুর মতো মুচকি হাসি দিচ্ছিলেন কিছুক্ষণ পর পর। তবে কি তিনি আগত শ্রোতাদের মতো নিজেও নিশ্চিত ছিলেন— সূর্য আসবেই, সকাল হবেই। ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে ২ ঘণ্টা। ঢোলের বোলে বাঁশি দিয়ে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই খেলা শুরু করেন তিনি। এভাবে অনেকটা সময় বাঁশি বাজিয়ে উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলে ওঠেন, ‘আমার তরফ থেকে বলতে পারি, আমি পুরো দিন বাজাতে পারব, সত্যি।’ এর পর সময়সংকট মনে করিয়ে দিয়ে বিদায় নেন, যদিও ভক্তরা যে তা মানতে নারাজ।

এবার ফিরে আসা যাক, মঞ্চের পেছনটায়। হরিপ্রসাদ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেবলই বাইরে এসেছেন। এক ঝটকায় ছুটে যাওয়া হলো তার কাছে। নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বচসা করে হরিপ্রসাদকে ইশারায় বলা হলো, কেমন আছেন? তিনিও দুহাত বুকের কাছে নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ভালো আছেন। খানিকটা সুযোগ পেয়ে তার কাছে প্রশ্ন, আগামী বছর আবার আসবেন তো? হেসে দিয়ে এত মানুষের ভেতর থেকেও বলে উঠলেন— ‘কেন নয়, শরীর সুস্থ থাকলে আবার আসব তোমাদের দেশে।’ খানিক বাদে বিদায় নিলেন তিনি। মনে হলো, এতক্ষণ ধরে যে সূর্যটাকে তিনি নামিয়ে আনলেন, সেটি যেন আবার তার পিছু নিয়েছে!