Menu

সুরের অবগাহন

thumbnail

দীপন নন্দী

প্রবেশে নানা বাধা। নিরাপত্তার কারণে ব্যাগ নেওয়া যাবে না, গাড়ি রাখার ব্যবস্থা নেই, একবার বের হলে আর প্রবেশ করা যাবে না- এরকম নানা বিধিনিষেধ। তবে শুদ্ধসঙ্গীতের সুরের অবগাহনে আসা শ্রোতাদের কাছে এসব বড় কিছু নয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই সঙ্গীতপ্রেমীরা ছুটে আসছেন রাজধানীর বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে, যেখানে বসেছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের পঞ্চম আসর। সুবিন্যস্ত মঞ্চে নিজেদের পরিবেশনায় শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখছেন বাংলাদেশ ও ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপালরা। সঙ্গে রয়েছেন শিক্ষার্থীরাও। গতকাল শনিবারের পরিবেশনা সূচনা হয় বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীদের সরোদ বাদনের

মধ্য দিয়ে, আর খেয়াল দিয়ে সমাপ্তিরেখা টানেন ওস্তাদ রশিদ খান। মাঝে ছিল শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যনের বাঁশি, প্রভা আত্রের খেয়াল, পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের তবলা, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকারের ধ্রুপদ আর পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের সুর। সব মিলিয়ে সুরের ইন্দ্রজাল, যাতে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বুঁদ ছিলেন হাজারও দর্শকশ্রোতা। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের এবারের আসর নিবেদন করছে স্কয়ার এবং সহযোগিতায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে।

তৃতীয় দিনের আয়োজনের শুরুতে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের সরোদের পরিবেশনায় অংশ নেন কামাল জহির শামীম, খন্দকার শামছুজোহা, ইলিয়াস খান, ইলহাম ফুলযুরী খান, ইশরা ফুলযুরী খান, শরীফ মুহাম্মাদ আরিফিন রনি ও আল জোনায়েদ দিদার। তারা পরিবেশন করেন রাগ কাফি। এ সময় তবলা বাজান পিনু সেন দাস ও রতন কুমার দাস। পরিবেশনা শেষে এবারের আসরের সবচেয়ে খুদে শিল্পী ইশরা ফুলযুরী খানের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন শিল্পী হাশেম খান।

এর পর কর্নাটকি বাঁশি নিয়ে মঞ্চে আসেন শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন। বিশ্বের বড় বড় সঙ্গীত উৎসবে অংশ নেওয়া এ শিল্পীর বাঁশিতে সুর উঠে রাগ পূরবী কল্যাণীর। এর পর ঐতিহ্যবাহী কম্পোজিশন বাজিয়ে শেষ করেন তার পরিবেশনা। শিল্পীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার, মৃদঙ্গমে পারুপল্লী ফাল্গুন ও তানপুরায় এলভিন মজুমদার।

এর পর মঞ্চে আসেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের অন্যতম শিল্পী ড. প্রভা আত্রে। কিরানা ঘরানার অগ্রজ এ শিল্পী খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা, গজল ও নাট্যসঙ্গীতে সমান পারঙ্গম। তার পরিবেশনায় তবলায় সঙ্গত করেন রোহিত মজুমদার। প্রথমেই তিনি পরিবেশন করেন রাগ শ্যামকল্যাণ। এর পর নিজের সৃষ্টি রাগ মধুরোকোষে খেয়াল পরিবেশন করে মুগ্ধ করেন সবাইকে। এর পর তিনি রাগ কানাড়ায় দাদরানায়কি পরিবেশন করেন। সবশেষে রাগ ভৈরবীতে ভজন পরিবেশন করে নিজের পরিবেশনা শেষ করেন।

এর পরে আসেন ফরুখাবাদ ঘরানার অন্যতম তবলাবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বঙ্গোপাধ্যায়। তার সঙ্গে তবলায় আরও ছিলেন অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনি তিন তালে বিভিন্ন কম্পোজিশন পরিবেশন করেন।

এর পর ধ্রুপদ পরিবেশন করেন পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর। কুমার গান্ধর্ব সম্মাননাপ্রাপ্ত এ শিল্পী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করতে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা ধ্রুপদে মুগ্ধ হন দর্শকশ্রোতারা। তার সঙ্গে পাখওয়াজে ছিলেন প্রতাপ আওয়াদ। পরে সেতার পরিবেশন করেন পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ চেয়ার অধ্যাপক পদে আসীন। তার সেতারের সুর মূর্ছনায় তবলার বোলে ভিন্নমাত্রা যোগ করেন পরিমল চক্রবর্তী। ভোররাতে মঞ্চে আসেন ওস্তাদ রাশিদ খান। ভারতের অন্যতম এ খেয়ালিয়া রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা এনায়েত হোসেন খাঁর প্রপৌত্র। বিলম্বি আলাপের আবেগময়তা, বিস্তারের গভীরতা ও তানকারীর ব্যতিক্রমী পরিবেশনায় তিনি মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তৃতীয় রাতের আয়োজন শেষ হয়।

বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী :শুধু শুদ্ধসুরে ভেসে যাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই এবারের আয়োজন। আর্মি স্টেডিয়ামের এক কোণে চলছে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনীতে রয়েছে উপমহাদেশের নানা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। এসবের কোনোটি বহুল পরিচিত, কোনোটি আবার চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাদ্যযন্ত্রের পাশে রয়েছে এর পরিচিতিও। প্রদর্শনীতে রয়েছে পাখোয়াজ, সরোদ, টিকিয়া, অ্যাকর্ডিয়ান, সুনাদ, নাকাড়া, হারমোনিয়াম, ইন্ডিয়ান ব্যাঞ্জো, সারেঙ্গী, এস্রাজ, যুগী সারেঙ্গী, কর্নেট, ক্ল্যারিনেট, বিউগল, ট্রাম্পেট, সানাই, মেঁকুড়, প্রেমজুড়ি, তানপুরা, মাদল, স্বরাজ, গোপীযন্ত্র, সারিন্দা, আনন্দনহরিসহ অনেক বাদ্যযন্ত্র।

শুক্রবার মধ্যরাতের আয়োজন : শুক্রবার মধ্যরাতে সেতারের সুরে দর্শকশ্রোতাদের মুগ্ধ করেন পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়। তিনি রাগ হেমললিতে আলাপ জোড় ঝালা এবং গৎ পরিবেশন করেন। এ ছাড়া লোকজ সুরে ধুন বাজিয়ে শোনান। তার সঙ্গে তবলায় ছিলেন অনুব্রত চ্যাটার্জি ও তানপুরায় মুশফিকুল ইসলাম। এর পর পণ্ডিত উলহাস কশলকর খেয়াল পরিবেশন করেন। প্রথমে তিনি পরিবেশন করেন রাগ বসন্ত বাহার। এর পর রাগ সোহনি এবং রাগ খাম্বাজে ঠুমরি ও তারানা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকার, হারমোনিয়ামে মিলিন্দ কুলকার্নি এবং তানপুরায় অভিজিৎ কণ্ডুু ও উজ্জ্বল কুমার মালাকার। দ্বিতীয় রাতের শেষ পরিবেশনা ছিল পণ্ডিত রনু মজুমদার ও ইউ রাজেশের। তারা বাঁশি ও ম্যান্ডোলিন পরিবেশন করেন। রনু মজুমদার বাঁশিতে মঙ্গল ভৈরব ও ইউ রাজেশ ম্যান্ডোলিনে রাগ অমৃত বর্ষিণী পরিবেশন করেন। রাগ নট ভৈরব পরিবেশন করেন দু’জন একসঙ্গে। শেষে দর্শকদের অনুরোধে ভাওয়াইয়া পরিবেশন করে পরিবেশনা শেষ করেন তারা। শিল্পীদের মৃদঙ্গে সহায়তা করেন এস ভি রামানি এবং তবলায় ছিলেন পণ্ডিত অভিজিৎ ব্যানার্জি।

আজকের আয়োজন :আজ রোববার উৎসবের চতুর্থ দিনের আয়োজনের শুরুতেই কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবেন মুনমুন আহমেদ ও তার দল রেওয়াজ। এর পর এক তবলায় বোল তুলবেন নীলেশ রণদেব। খেয়াল পরিবেশন করবেন কিরানা ঘরানার শিল্পী জয়তীর্থ মেউন্ডি। তবলায় যুগলবন্দি পরিবেশন করবেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি ও পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যুগলবন্দি কর্নাটকি সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী বেহালাবাদক চুটি রঞ্জনি ও গায়ত্রী বালসুব্রহ্মণ্যন ভগি্নদ্বয়। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার পরিবেশন করবেন সরোদ। এ দিনের অনুষ্ঠান শেষ হবে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।

View Full Article