Menu

সুরের মায়া ছড়াল বেঙ্গলের শাস্ত্রীয়সংগীত উৎসব

শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গসংগীতের ঐতিহ্যগত গঠন ও কৌশলের প্রতি সাধারণ শ্রোতাদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনার লক্ষে ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’ শেষ হলো। গত ২৬ ডিসেম্বর কাজাখস্তানের ৫৮ সদস্যের আস্তানা সিম্ফনি ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা দলের পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল সংগীতের সুরে শুরু হওয়া এই উৎসবটি আজ ভোরে চৌরাশিয়ার মনোমুগ্ধকর বাঁশি’র সুরে সমাপ্ত হচ্ছে।

দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সংস্কৃতিচিন্তক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে উৎসর্গ করা এই মহাসংগীতযজ্ঞটির গতকাল ছিল পঞ্চম ও শেষ দিন। পৌষের সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্বখ্যাত ভারতীয় নৃত্যশিল্পী সুজাতা মহাপাত্র’র ওড়িশি নৃত্য পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে শুরু ‘সংগীত জাগায় প্রাণ’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যের এবারের এ উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিনের আয়োজন। এরপর মঞ্চে যন্ত্রসংগীতের সুর-ঝঙ্কার নিয়ে হাজির হন-পন্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। তিনি বাজিয়ে শোনান ‘মোহনবীণা’। তার এ মোহনবীণা’র মোহনীয় সুরের রেশ কাটতে না কাটতেই কণ্ঠে খেয়াল পরিবেশন করতে মঞ্চে আসেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। তারপরেই শুরু হয় যুগল সেতার বাদন। এ যুগল সেতার বাদনে অংশ নেন পন্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণজিত দাস। এরপর সময়ের ক্রমাগত চলনে হাজির হয় রাতের একেবারে শেষ ভাগ। এ পর্যায়ে পন্ডিত কৈবল্যকুমার গুরাভ তার সেতারে মনমোহিত শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরে মুগ্ধ করেন উপস্থিত হাজার হাজার শাস্ত্রীয় সংগীতে বিমুগ্ধ শ্রোতাদের। আর তারপরেই এক বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চে আসেন পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। বাজিয়ে শোনান তার মন্ত্রমুগ্ধ করা হাজার হাজার সংগীতপ্রিয় মানুষের আরাধ্যের সেই বাঁশি। বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও তিনি তার মন্ত্রমুগ্ধকর বাঁশির সুরে মাতিয়ে তোলেন সংগীত প্রিয় কয়েকহাজার মানুষদের। তার বাঁশির সুরের ভেলায় ভেসে ভেসে হয় ভোর, মানুষের মনে ঘরে ফেরার তাগিদ না থাকলেও একসময় ফিরতে হয় বাড়ি। আর এর সাথেই শেষ হলো এবারের এই হবে না হবে না করেও শেষ পর্যন্ত আর্মি স্টেডিয়ামের পরিবর্তে ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৭’-এর আয়োজন। তারই সঙ্গে শুরু হলো আবারও এক বছরের অপেক্ষার প্রহর গুনন।

৬ষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত এবারের এ উৎসবের চতুর্থ দিনের অনুষ্ঠান : পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনের আয়োজন শুরু হয় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের দলগত নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। ‘নৃত্য চিরন্তন : মনিপুরি, ভারতনাট্যম, কত্থক নৃত্যার্ঘ’ শীর্ষক দুই পর্বে ভাগ করা এ পরিবেশনাটির নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ পন্ডিত বিরজু মহারাজ, শিবলী মোহাম্মদ এবং নৃত্য ভাবনা, সার্বিক নৃত্য পরিচালনা ও সম্বনয়কারী হিসেবে ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম পর্বে পরিবেশিত হয় মনিপুরি, ভরতনাট্যম, ও কত্থক নৃত্যের উপস্থাপনা।

মনিপুরি নৃত্যে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রায় রাধা রুপ বর্ণন করেন সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা; নৃত্য ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ এবং কণ্ঠে ছিলেন কলাবতী দেবী। গানের কথা নেওয়া হয়েছে বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের একটি ভক্তি কবিতা থেকে। এরপর তাল-সপ্ততাল ২০ মাত্রায় কালীয় দমন পরিবেশন করেন সুইটি দাস; নৃত্য ও সংগীত পরিচালনা করেন বিপিন সিংহ, কণ্ঠে ছিলেন দ্রৌপদি দেবী। মনিপুরি নৃত্যের সর্বশেষ অংশে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রা, চালি তাল-৮ মাত্রা, এবং মেনকুপ-৬ মাত্রায় পরিবেশত শিব স্তুতি। এ অংশের নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিম্বাবতী দেবী, সংগীত পরিচালনায় গুরু লাকপতি সিং, এবং কণ্ঠে দ্রৌপদি দেবী।

ভারতনাট্যম অংশে কীর্তি রামগোপালের নৃত্য পরিচালনায় ও ডি এন শ্রীভাৎসার সংগীত পরিচালনায়, বৃন্দাবনী রাগ ও আদি তালে সুরিয়া কথুরাম পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী। এরপর শিব স্তুতি পরিবেশন করেন জুয়েইরিয়াহ মৌলি। এতে নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন কীর্তি রামগোপাল, সঙ্গীত পরিচালনায় রামা সুব্রামানিয়াম শর্মা। শিব স্তুতিটি পরিবেশিত হয় আভোগী রাগে মিশ্র চাপু তালমে।

শিব স্তুতির পর কীর্তি রামেগাপালের নৃত্য পরিচালনায় ও পদ্মচরণের সংগীত পরিচালনায় এবং পূর্বী কল্যাণী রাগে ও আদি তালমে শিব কৃতি পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী। আর, কত্থক নৃত্যের শুরুতে তিনতালে গুরু বন্দনা করেন মেহরাজ হক তুষার। এরপর শুদ্ধ্য নৃত্য পরিবেশন করেন স্নাতা শাহরিন। তিনতালের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশিত এ কত্থক নৃত্যের সংগীত ও নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শিবলী মহম্মদ।

শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নৃত্য পরিচালনা ও রাহুল চ্যাটার্জির সংগীত পরিচালনায় (রবীন্দ্র সংগীত) এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে মনিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক সম্মিলনে নটরাজের প্রতি নৃত্যের মালিকা নিবেদন করা হয়। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মহুয়া মঞ্জুরী সুনন্দা, সুকান্ত চক্রবর্তী ও অভিজিৎ মজুমদার। পুরো নৃত্য পরিবেশনাটির ভাবনা, সার্বিক পরিচালনা ও সমন্বয়কারী ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

নৃত্যের পর সরোদ পরিবেশন করেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। দলগত পরিবেশনায় তারা রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের মা এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি মমতাজ খালেক।

এরপর মঞ্চ আলোকিত করেন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খান। রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী পুরিয়া রাগে খেয়াল পরিবেশন করেন। এ সময় তার সঙ্গে কণ্ঠ সহযোগী ছিলেন নাগনাথ আদগাঁওকার, তবলায় সঙ্গত করেন পন্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি, হারমোনিয়ামে ছিলেন অজয় যোগলেকর এবং সারেঙ্গিতে ছিলেন ওস্তাদ সাবির খান। পরিবেশনা শেষে মহান এই শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

খেয়াল শেষে ছিলো সরোদ এবং বেহালার যুগলবন্দী। পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ একসঙ্গে পরিবেশন করেন রাগ সিমেন্দ্রমধ্যমম। এ সময় তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পন্ডিত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার। পরিবেশন শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন-বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

এরপর খেয়াল পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পন্ডিত যশরাজ। তিনি প্রথমে রাগ যোগ-এ খেয়াল পরিবেশন করেন এবং পরে দুর্গা রাগে ভজন পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন রামকুমার মিশ্র, হারমোনিয়ামে পন্ডিতা তৃপ্তি মুখার্জি, কণ্ঠে রত্তন মোহন শর্মা এবং মৃদঙ্গমে শ্রীধার পার্থসারথী। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

খেয়াল শেষে প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে চেলো’র পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। তিনি রাগ নন্দকোষ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’- এ দুটি রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন পন্ডিত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুন্ডু ও টিংকু কুমার শীল। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক তপন চৌধুরী।

উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী পন্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির ‘সেতার’ বাদন। তিনি রাগ ললিত বিস্তার গৎ ঝালা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সৌমেন নন্দী। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন স্থপতি নাহাস খলিল।

 

View Full Article