সুরের স্রোতধারায় শহরে প্রাণের স্পন্দন
মনোয়ার হোসেন ॥ উৎসবটি হওয়ার কথা ছিল নবেম্বরে। না হওয়ার শঙ্কা নিয়ে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো ডিসেম্বরের শেষার্ধে। একইভাবে বদলে গেল সুরের বিপুল আয়োজনটির ভেন্যু। পাঁচ বছর ধরে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে চলা উৎসবটি ষষ্ঠ বছরে স্থানান্তরিত হলো ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে। এতসব পরিবর্তনের মাঝেও চরিত্র হারাল না শ্রোতার হৃদয় জয় করা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আসরটি। ছন্দপতনের আশঙ্কা ছাপিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হলো ষষ্ঠতম বেঙ্গল উচ্চা সঙ্গীত উৎসব। আর এবারই প্রথম প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের সংযোগ ঘটল এই সঙ্গীত আসরে। বিপুলসংখ্যক শ্রোতা-দর্শকের আগমনে প্রথম দিনেই মুখরিত হলো উৎসব। অর্কেস্ট্রার বাদন, বেহালার সুরধ্বনি, সেতার-সরোদের স্নিগ্ধতার সঙ্গে খেয়ালের মায়াবী শব্দনিনাদে শ্রোতার অন্তর আবৃত হলো প্রশান্তির পরশে। সেই সুবাদে যান্ত্রিক শহর ঢাকায় সুরের স্রোতধারায় বইল প্রাণের স্পন্দন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে। ‘সঙ্গীত জাগায় প্রাণ’ প্রতিপাদ্যে স্বয়ার নিবেদিত উৎসবে সহযোগিতায় রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক।
মঙ্গলবার পৌষের সন্ধ্যায় ধানম-ির আবাহনী মাঠে শুরু হয় পঞ্চম রজনীর এ উৎসব। বেহালার মধুময় সুরে এগিয়ে চলে প্রথম দিনের পরিবেশনা পর্ব। প্রথম পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন বিশ্বখ্যাত ভারতীয় বেহালাবাদক ড. এল সুব্রামানিয়াম। বেহালায় রাগ আভোগী পরিবেশন করেন। এ সময় তার সঙ্গে মৃদঙ্গে শ্রীরামামূর্তি ধূলিপালা, তবলায় প-িত তন্ময় বোস এবং মোর্সিংয়ে সত্য সাই ঘণ্টাশালা সঙ্গত করেন। বেহালার সুর থামতেই উৎসব আঙ্গিনায় ভেসে বেড়ায় অর্কেস্ট্রার সুর। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল কম্পোজিশনটি উপস্থাপন করে ৫৬ সদস্যের কাজাখস্তানের আসতানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রা। শ্রোতাকে মুগ্ধ করে দলটি প্রথমে সিলেস কাজগালি রচিত সিম্ফোনির কিছু অংশ এবং পি আই চাইকভস্কির বিখ্যাত সৃষ্টি ‘সোয়ান লেক’-এর কিছু অংশ পরিবেশন করে। অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেন দলটির বেরিক বাত্যরখান। অর্কেস্টার বাজনা শোনার মুগ্ধতার আরও বেড়ে যায় বেহালার সঙ্গে সুরের সম্মিলনে। এল সুব্রামানিয়ামের সঙ্গে যুগল পরিবেশনায় আসে সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা। পূর্ব-পশ্চিমের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধনে উপস্থাপিত হয় ‘শান্তিপ্রিয়া’ নামের পরিবেশনা। কখনো করুণ, কখনো উচ্ছ্বাস কিংবা আনন্দের রাগাশ্রয়ী পরিবেশনাটি আলোড়িত সুররসিকদের। পশ্চিমা সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যালের স্টাফ নোটেশনে উৎসবের বিশাল প্রান্তরে সৃষ্টি হয় অন্তর জুড়ানো সুরের আবেশ।
বেহালা ও অর্কেস্ট্রার যুগলবন্দী পরিবেশনার পর ছিল উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। প্রধান অতিথি হিসেবে উৎসব উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও আবাহনী লিমিটেডের সভাপতি সালমান এফ রহমান, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন ও স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা থেকে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ও বিদুষী গিরীজা দেবীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ উৎসবের প্রতিটিতেই উপস্থিত থেকেছি, এটা আমার সৌভাগ্য। এ উৎসবে আমরা পাঁচদিন নৃত্যগীতের মধ্যে অবগাহন করব। আমরা সবার আগে মানুষ হতে চাই, নিজেদের রুচিকে উন্নত করতে চাই। এ উৎসব সে পথেই প্রেরণা যোগাবে।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সঙ্গীত পরিশুদ্ধ করে আমাদের, আমাদের চিত্তকে উদার করে, আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সঙ্গীত আমাদের মুক্তচিন্তা অধিকারী করে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রেরণা যোগায়। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে সে মূল্যবোধ, চেতনাকে ধারণ করতে চাই। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সঙ্গীত আমাদের শক্তি যোগাবে। উৎসবটি আমাদের মধ্যে সেই চেতনার বিকাশ ঘটায়।
হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, এটি অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। বিশ্বের অন্যতম ধ্রুপদী উৎসবটি বিশে^র নানা প্রান্ত থেকে শিল্পীদের টেনে এনেছে। মহান শিল্পীদের সঙ্গীতে নিজেদের সমৃদ্ধ করব।
আবুল খায়ের বলেন, মানুষকে মানবিক হওয়ার জন্য আমাদের এই উৎসব আয়োজন। আর মন শুদ্ধ করার জন্য গান সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। এরপর তিনি ঘোষণা দেন, আগামী বছর এ উৎসব উৎসর্গ করা হবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ২০১৯ সালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং ২০২০ সালে ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুনকে।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতার পর সরোদের সুরে উৎসব রাঙান বিবাহসূত্রে বাংলাদেশে বসতি গড়া সরোদিয়া রাজরূপা চৌধুরী। উপস্থাপন করেন গুরু সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী সৃষ্ট অনীল মাধ্যমে নামের রাগ। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন প-িত অভিজিৎ ব্যানার্জী। এরপর কণ্ঠে খেয়াল নিয়ে মঞ্চে আসেন বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকর। পরিবেশন করেন গোয়ালিয়র, কিরানা ও জয়পুর ঘরানায় খেয়াল। এরপর সেতারে সুর ছড়িয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী ফিরোজ খান। বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী সুপ্রিয়া দাস পরিবেশন করেছেন খেয়াল। প্রথম দিনের উৎসবের শেষ হয় সেতার ও বাঁশির যুগলবন্দী পরিবেশনায়। পরিবেশনাটি উপস্থাপন করেন ভারতীয় বংশীবাদক রাকেশ চৌরাশিয়া ও সেতারবাদক পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়। প্রথম দিনের উৎসবটি সুচারুরূপে সঞ্চালনা করেন অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার।
উৎসবের টুকিটাকি ॥ সঙ্গীত উপভোগের পাশাপাশি খাবার ও পানীয়ের জন্য উৎসব প্রাঙ্গণে রয়েছে ফুডকোর্ট। পাশাপাশি উৎসব আঙিনায় রয়েছে দেশের সঙ্গীত সাধক ও তাদের জীবনীভিত্তিক সচিত্র প্রদর্শনী এবং বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস এ্যান্ড সেটলমেন্টের ‘সাধারণের জায়গা’ শীর্ষক প্রদর্শনী। এছাড়া উৎসব প্রাঙ্গণে রয়েছে বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল এক্সপ্রেস, বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়, অরণ্য, বেঙ্গল ভিজ্যুয়াল আর্টস প্রোগ্রাম, বেঙ্গল বই, ব্র্যাক ব্যাংক ও স্কয়ার গ্রুপের স্টল স্থাপন করেছে । আছে ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ।
আজকের উৎসবসূচী ॥ আজ বুধবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবেন অদিতি মঙ্গলদাস ড্যান্স কোম্পানির নৃত্যশিল্পীরা। তবলা বাদনে অংশ নেবেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এরপর সন্তুর নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হবেন গত আসরগুলোয় শ্রোতাকে মুগ্ধ করা পন্ডিত শিবকুমার শর্মা। খেয়াল পরিবেশন করবেন পন্ডিত উলহাস কশলকর, সেতার বাজিয়ে শোনাবেন ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খান। ধ্রুপদ পরিবেশন করবেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিত কুন্ডু। সব শেষে থাকবে পন্ডিত রনু মজুমদার বাঁশি এবং পন্ডিত দেবজ্যোতি বোস সরোদে যুগলবন্দী পরিবেশনা ।