Menu

সুরে মগ্ন হাজার হাজার সংগীত পিয়াসী মানুষ

‘শাস্ত্রীয়সংগীত, লোকসংগীতের নানা স্রোতকে নিয়মবদ্ধভাবে পাওয়ার চেষ্টা থেকেই জন্ম। সংগীত সবচেয়ে সহজে মানুষের মনের ভেতরের ভাষাটাকে প্রকাশ করে। কেননা, সংগীত মানুষের অস্তিত্ব দিয়ে তৈরি এবং মানুষের মনের খাদ্য হচ্ছে গান।’-২০১৩ সালে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে গাইতে এসে ‘শিল্পীর মুখোমুখি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী’র বলা এই কথারই যেন সত্যতার সাক্ষর রেখে গেল আরও একবার। ‘নিজেকে প্রকাশ করাই সংগীত’-পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী’র একথার সাথে সুর মিলিয়ে গতকাল ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৭’-এর তৃতীয় দিনের আয়োজনে-তবলার বোল, ঘাটম ও কঞ্জিরা, সরোদ, বাঁশি আর বেহালা মতো মনোহরণকারী যন্ত্রের মোহনীময় সুর-মূর্ছনা তালবাদ্যে ধ্যানমগ্ন অনুরণন আর শাস্ত্রীয়সংগীত অঙ্গণের কণ্ঠের রথী-মহারথীদের নিজেকে প্রকাশের আর ছাড়িয়ে যাওয়ার জাদুকরী পরিবেশনায় মুগ্ধ করলেন হাজার হাজার সংগীত প্রিয় মানুষকে।

পৌষের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই হেমন্তের হালকা শীতের হালকা শিশিরের পেলব স্পর্শ আর বর্ণিল আলোয় সেজে ওঠা রাজধানীর ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের স্নিগ্ধ পরিবেশ সংগীতজ্ঞদের সুরের অনুরণনে হয়ে ওঠে সংগীতময়। শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গসংগীতের ঐতিহ্যগত গঠন ও কৌশলের প্রতি সাধারণ শ্রোতাদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনার লক্ষে ২০১২ সাল থেকে আয়োজিত এবারের ৬ষ্ঠ আসরের গতকাল তৃতীয় দিন গতকাল সন্ধ্যার ঠিক পূর্বমুহূর্তে থেকেই আবাহনী মাঠে সংগীতপ্রিয় দর্শক-শ্রোতার উচ্ছসিত আগমন। উদ্দেশ্য একটা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুখ-সাগরে নিজেকে সমর্পণ করে ঋব্ধ হওয়া। এদিন, কুয়াশাসিক্ত পৌষের সন্ধ্যা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলে উপমহাদেশের শাস্ত্রীয়সংগীতের দিকপাল শিল্পীদের সঙ্গে বাংলাদেশি শিল্পীদের কণ্ঠে সুর-লহরা আর হৃদয়ে স্নিগ্ধতা ছড়ানো সন্তুর-সেতারের মধুময় শব্দধ্বনি। শাস্ত্রীয়সংগীতের সুর লহরীর টানে এদিনও সন্ধ্যা-রাত-ভোর সুরের নেশায় মগ্ন ছিলেন প্রায় অর্ধ লাখ সংগীত পিপাসু মানুষ। কেউ একা, কেউবা পরিবার-পরিজন আবার কেউ প্রিয় মানুষ সঙ্গী করে এসেছিলেন। ভেসে গিয়েছিলেন সুন্দরের পিয়াসী অবগাহনে।

সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশের বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের সেতারের ঝঙ্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান। তাদের সেতারে রাগ ‘কিরওয়ানি’র মোহনীয় মিহি সুরে যেন ঝরে পড়ছিল স্বর্গীয় বাণীপুঞ্জ। পরিবেশনায় অংশ নেন প্রসনজিৎ ম-ল, টিএম সেলিম রেজা, রিংকো চন্দ্র দাস, মেহরীন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জি, মোহাম্মদ কাওসার ও জাহাঙ্গীর আলম।

এরপরেই বাদ্যযন্ত্রে ‘ঘাটম ও কঞ্জিরা’য় শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরের ডালি নিয়ে মঞ্চে আসেন বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়ক রাম ও সেলভাগণেশ বিনায়ক রাম। কর্ণাটকি ‘ঘাটম ও কঞ্জিরা’র যুগলবন্দির এ পরিবেশনায় ‘ঘাটম’ বাজিয়ে শোনান ভারতের কর্ণাটকি ঘরাণার খ্যাতিমান শিল্পী বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়ক রাম ও ‘কঞ্জিরা’ বাঁজিয়ে শোনান শিল্পী সেলভাগণেশ বিনায়ক রাম। গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডজয়ী বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়ক রাম ও তার পরবর্তী তিন প্রজন্মও এতে অংশ নেয়। তাদের এ ‘ঘাটম ও কঞ্জিরা’য় শুরুতেই বাজিয়ে শোনান সনাতন ধর্মের পুরাণের শিবতান্ডব। এরপরেই তার বাজিয়ে শোনান ‘সেভেন অ্যান্ড এ হাফ’ শীর্ষক ‘ঘাটম ও কঞ্জিরা’র যুগল বাদন শেষে মুগ্ধ শ্রোতাদের ভালোলাগার মহিমায় নতুন পালক যোগ করতে খেয়াল পরিবেশন করতে আসেন-দেশের সরকারি সংগীত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরপর ‘সরোদ’-এ উচ্চাঙ্গসংগীতের সুরের আবেশ ছড়িয়ে পৌষের শীতের রাতে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেন সরোদ বাদন শিল্পী আবির হোসেন। সরোদের সেই আবেশমাখা সুরের রেশ যেতে না যেতেই মঞ্চে আসেন দেশের প্রখ্যাত বংশিবাদক গাজী আবদুল হাকিম। এরপর শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশেষ ধারার উচ্চমার্গীয় সংগীত ‘ধ্রুপদ’ পরিবেশন করতে আসেন শিল্পী পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর। তার ধ্রুপদ পরিবেশনের শেষে কুয়াশাআবৃত আকাশের বেদনাক্লিষ্ট চেহারার চাঁদের সঙ্গে উপস্থিত কয়েক হাজার সংগীতপ্রিয় মানুষকে বিমোহিত করতে ‘বেহালা’ নিয়ে মঞ্চে আসেন বেহালাবাদন শিল্পী বিদুষী কালা রামনাথ। আর, এদিনের আয়োজনের সবশেষে খেয়াল পরিবেশন করবেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। তার এ পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে শেষ হবে তৃতীয় দিনের উৎসব।

দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা এবং প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্য দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সংস্কৃতিচিন্তক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে উৎসর্গ করা এই মহাসংগীতযজ্ঞটির আজ চতুর্থ দিন। এদিনের উৎসব শুরু হবে দলীয় নৃত্যর ছন্দময় দোলায়। ভরতনাট্যম এবং কত্থক নৃত্য পরিবেশনে অংশ নেবেন- নৃত্যশিল্পী সুইটি দাস, অমিত চৌধুরী, স্নাতা শাহরিন, সুদেষ্ণা স্বয়মপ্রভা, মেহরাজ হক এবং জুয়াইরিয়াহ মৌলি। তাদের এ সম্মিলিত এই নৃত্য পরিবেশনের পরেই ‘সরোদ’-এ শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর ছড়াবে ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’-এর শিক্ষার্থীরা। এরপর খেয়াল পরিবেশন করবেন পৃথিবীখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ওস্তাদ রশিদ খান। রশিদ খানের মায়াময় অনন্য কণ্ঠের খেয়ালের পরেই ‘সরোদ ও বেহালা’ যুগলবন্দি পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসবেন-পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ। এতে সরোদ বাজাবেন পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং বেহালায় থাকবেন ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ। তাদের এ যুগল পরিবেশনা শেষে মঞ্চে ফের পরিবেশিত হবে খেয়াল। এবারের খেয়ালের শিল্পী পণ্ডিত যশরাজ। এরপরেই রাতের শেষভাগে যন্ত্রসংগীত নিয়ে মঞ্চে উপনিত হবেন-সাসকিয়া রাও দ্য-হাঁস এবং পণ্ডিত বুদ্ধাদিত্য মুখার্জি। এর প্রথমেই ‘চেলো’ পরিবেশনায় অংশ নেবেন- সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। অতঃপর রাতের একেবারে শেষভাগে পণ্ডিত বুদ্ধাদিত্য মুখার্জি ‘সরোদ’-এ শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর-সুধায় শেষ হবে চতুর্থ দিনের আয়োজন।

এদিকে, এ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের ভারতের ‘অদিতি মঙ্গলদাস ড্যান্স কোম্পানি’র কত্থক নৃত্যের ছন্দ-ঝঙ্কার শুরু হওয়া দ্বিতীয় দিনের আয়োজন শেষ হয় বাদ্যযন্ত্র বাঁশি আর সরোদের যুগলবন্দি’র সুর-তাল-লয়ে। দ্বিতীয় দিনের প্রথম পরিবেশনা কত্থক নৃত্যের পরেই অনুষ্ঠিত হয় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের তবলা বাদন। সুরেশ তলওয়ালকরের পরিচালনায় এতে তবলায় শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর তোলেন- প্রশান্ত ভৌমিক, সুপান্থ মজুমদার, এম জে জেসাস ভুবন, ফাহমিদা নাজনিন, নুসরাত-ই-জাহান এবং শ্রেষ্ঠা প্রিয়দর্শিনী। তারা রাগ কিরওয়ানি নাগমায় তিন তালে কম্পোজিশন পরিবেশন করেন।

এরপর মঞ্চে ওঠেন প্রখ্যাত সন্তুর শিল্পী পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। তিনি পরিবেশন করেন রাগ ঝিঁঝোটিতে আলাপ, জোড়, ঝালা ও গৎ। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন- যোগেশ শামসি, তানপুরায় ছিলেন তাকাহিরো আরাই। এরপরেই আসরে খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর। তিনি প্রথমে পরিবেশন করেন রাগ যোগকোষ এবং পরে গেয়ে শোনান রাগ সোহিনী। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন সুরেশ তলওয়ালকার। সেতার পরিবেশন করেন ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খাঁ, তার সাথে তবলায় ছিলেন অভিজিৎ ব্যানার্জি। তিনি সেতারে বাগেশ্রী রাগ। অতঃপর মঞ্চে ধ্রুপদ সংগীত পরিবেশন করতে আসেন- অভিজিৎ কু- ও বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের পাখোয়াজে সঙ্গত করছেন সুখাদ মুন্ডে, তানপুরায় ছিলেন জ্যাতাশ্রী রায় চৌধুরী এবং টিংকু কুমার শীল। এ সময় শিল্পীরা পরিবেশন করেন রাগ বেহাগ।

এরপরই এদিনের মঞ্চে কাক্সিক্ষত বাঁশির মোহনীয় সুরের ভেলায় ভাসাতে আসেন পণ্ডিত রনু মজুমদার। তার সঙ্গে সরোদে যুগলবন্দিতে ছিলেন পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোস। বাঁশি আর সরোদের এ যুগলবন্দি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন যোগেশ সামসি এবং অভিজিৎ ব্যানার্জি। বরেণ্য এই শিল্পীরা পরিবশেন করেন ভোরবেলার রাগ আহীর ভৈরব। তাদেও এ পরিবেশনা শেষে শেষ হওয়ার কথা ছিলো দ্বিতীয় দিনের অয়োজন। কিন্তু বাঁশি আর সরোদের যুগলবন্দি’র সুর-তাল-লয়ে বিমোহিত দর্শকদের অনুরোধে তারা ভাটিয়ালি ধুন পরিবেশন করেন। ভাটিয়ালি ধুন পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় দিনের আয়োজন।

স্কয়ার নিবেদিত এবারের আসরে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশ ও ভারত এবং পশ্চিমাদেশ কাজাখস্তানের ২ শতাধিক শিল্পী। শিল্পী ও দর্শকের অংশগ্রহণ এবং ব্যাপ্তির বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উচাঙ্গসংগীতাসরে পরিণত হওয়া বৃহৎ এ আয়োজনটি সাজানো হয়েছে দেশের নবীন শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীদের সঙ্গে শ্রোতার মন উচাটন করা উপমহাদেশের ওস্তাদ, পণ্ডিত, গুরু ও বিদুষীদের অনবদ্য পরিবেশনা দিয়ে।

এবারের এ আয়োজন সমর্থন করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, মেডিকেল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, অনুষ্ঠানে সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল আই, মিডিয়া পার্টনার আইস বিজনেস টাইমস, আতিথেয়তা সহযোগী প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও। আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় ব্লুজ কমিউনিকেশনস। উৎসবের সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছে সিঙ্গাপুরের পারফেক্ট হারমনি।

 

View Full Article