সুরে সমর্পিত রাত
আবাহনীর মাঠে বসেছিল সুরের তারকাদের মিলনমেলা। আর সেই তারকাদের সুরের আলোকছটায় স্নাত হয়েছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরাগীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সুরের পেয়ালা আকণ্ঠ পান করছিল রাগ, আলাপ, খেয়াল, সরোদ, বেহালা, সেতারে মত্ত শাস্ত্রীয় সংগীতের সমঝদার শ্রোতারা। আর উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীরাও দরদমাখা আবেগিক পরিবেশনায় শ্রোতাদের হৃদয়ের পাত্রখানি পূর্ণ করে দিল। সুর আর শ্রবণেই সীমাবদ্ধ থাকল না, পরিণত হলো সাধনাতে। এমন চিত্রকল্পই ছিল গতকাল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ রাতের আসরে। যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে কণ্ঠসংগীত ও শাস্ত্রীয় নাচের অনন্য সৌন্দর্যে এ রাতটিকে শৈল্পিকতার চাদরে ঢেকে দেন শিল্পীরা। এ রাতের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন পদ্মশ্রী, সংগীত নাটক একাডেমি, গ্লোবাল ইন্ডিয়ান মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস এবং মহাসংগীত সম্মানে ভূষিত ভারতীয় ওস্তাদ রশিদ খান। কণ্ঠে বিলম্বিত আলাপের আবেগময়তায় বিস্তারের গভীরতা ও দক্ষতায় কণ্ঠসংগীতে অপূর্ব ব্যঞ্জনা তৈরি করেন রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার ভারতীয় এই শাস্ত্রীয় শিল্পী। প্রথমেই তিনি ‘রাগ পুরিয়া’য় খেয়াল পরিবেশন করেন। এরপর নিজের সৃষ্টি ‘প্রিয়ারঞ্জনী’ রাগে ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে দিয়ে নিজের পরিবেশনা শেষ করেন ওস্তাদ রশিদ খান। তার সঙ্গে কণ্ঠ সহযোগী ছিলেন নাগনাথ আদগাঁওকার, তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি, হারমোনিয়ামে ছিলেন অজয় যোগলেকর এবং সারেঙ্গিতে ছিলেন ওস্তাদ সাবির খান। পরিবেশনা শেষে ওস্তাদ রশিদ খানের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের দলীয় নৃত্যের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চতুর্থ রাতের পর্দা ওঠে। প্রথম পর্বে পরিবেশিত হয় মনিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক নৃত্যের উপস্থাপনা। মনিপুরি নৃত্যে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রায় রাধা রূপ বর্ণনা করেন সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা। গানের কথা নেওয়া হয়েছে বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের একটি ভক্তি কবিতা থেকে। এরপর তাল-সপ্ততাল ২০ মাত্রায় কালীয় দমন পরিবেশন করেন সুইটি দাস। মনিপুরি নৃত্যের সর্বশেষ অংশে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রা, চালি তাল-৮ মাত্রা এবং মেনকুপ-৬ মাত্রায় পরিবেশিত শিবস্তুতি। এ অংশের নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিম্বাবতী দেবী, সংগীত পরিচালনায় গুর লাকপতি সিং এবং কণ্ঠে দ্রৌপদি দেবী। ভরতনাট্যম অংশে কীর্তি রামগোপালের নৃত্য পরিচালনায় ও ডি এন শ্রীভাৎসার সংগীত পরিচালনায় বৃন্দাবনী রাগ ও আদি তালে সূরিয়া কথুরাম পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী। এরপর শিবস্তুতি পরিবেশন করেন জুয়েইরিয়াহ মৌলি। এতে নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন কীর্তি রামগোপাল, সংগীত পরিচালনায় রামা সুব্রামানিয়াম শর্মা। শিব স্তুতিটি পরিবেশিত হয় আভোগী রাগে মিশ্র চাপু তালমে। শিবস্তুতির পর কীর্তি রামগোপালের নৃত্য পরিচালনায় ও পদ্মচরণের সংগীত পরিচালনায় এবং পূর্বী কল্যাণী রাগে ও আদি তালমে শিব কৃতি পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী। কত্থক নৃত্যের শুরুতে তিনতালে গুরু বন্দনা করেন মেহরাজ হক তুষার। এরপর শুদ্ধ নৃত্য পরিবেশন করেন স্নাতা শাহরিন। তিনতালের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশিত এ কত্থক নৃত্যের সংগীত ও নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শিবলী মোহাম্মদ। শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নৃত্য পরিচালনা ও রাহুল চ্যাটার্জির সংগীত পরিচালনায় এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে মনিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক সম্মিলনে নটরাজের প্রতি নৃত্যের মালিকা নিবেদন করা হয়। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মহুয়া মঞ্জুরী সুনন্দা, সুকান্ত চক্রবর্তী ও অভিজিৎ মজুমদার।
পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের মা এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি মমতাজ খালেক।
এরপর মঞ্চে আসেন নেদারল্যান্ডসে বসবাসকারী ভারতীয় শিল্পী সাসকিয়া রাও। চেলাতে ভিন্নধর্মী সুরের ব্যঞ্জনায় আবাহনী মাঠে ভিন্ন এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেন এই শিল্পী। ইমদাদখানি ঘরানার সেতারবাদক বুধাদিত্য মুখার্জির সেতারের সুরেই শেষ হয় চতুর্থ রাতের আসর। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ উৎসবের নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ।
আজ শেষ রাতের পরিবেশনা শুরু হয়ে শেষ হবে কাল ভোরে। গবেষক, চিন্তক ও শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানকে এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে।