Menu

সৃষ্টিকর্তাই গায় সৃষ্টিকর্তাই শোনে

thumbnail

হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তিদের অন্যতম পণ্ডিত যশরাজ। কণ্ঠ সংগীতের পুরোধা এই ব্যক্তিত্বের ভক্তকুল ভারতের সীমানা ডিঙিয়ে ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে। প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছেন। তবে বাংলাদেশে এটাই তাঁর প্রথম সফর নয়। এর আগে শিল্পকলায় আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন গান করতে।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রবীণ এই শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী। হাঁটতে কষ্ট হয়। হুইল চেয়ারে করে সম্মেলনস্থলে আসেন তিনি। সঙ্গে এনেছেন মেয়ে দুর্গা যশরাজকে।

আস্তে আস্তে কথা বলেন। খুব একটা ভালো বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে ইংরেজি ও হিন্দিতে চলে যান। বাড়ি তাঁর ব্রিটিশ পাঞ্জাবের ফতেহাবাদ জেলার পিলি মান্দারি গ্রামে।

পণ্ডিত যশরাজ আজ শুক্রবার রাতে ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের ষষ্ঠ আসরের চতুর্থ দিনে খেয়াল পরিবেশন করবেন। কেমন হবে তা নিয়ে পণ্ডিতজীর মাঝে কিছুটা সংশয়। বললেন, ‘এটা তো বলা যায় না। হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে—রাগ, রসুই পাগড়ি কাভি কাভি বান যায়।’

বার্ধক্য গানের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় নয়। তিনি বলেন, ‘গান-বাজনায় স্পিরিচ্যুয়াল বলে একটি জিনিস আছে। এটা দিনে দিনে বেড়ে যায়।’

মাথার তালুতে তর্জনী ঠেকিয়ে পরে বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে বললেন, ‘গান এখান থেকে আসে, এইখান থেকে। আর যে জিনিস আপনি কোনোদিন ভাবেননি সেটা আসে ভেতর থেকে। ভেতর থেকে টানটা আসে। দেখো, আমি তো সব জিনিস ব্যবস্থা করে রেখেছি। তুমি খোঁজো। খুঁজবো! কোথায় খুঁজবো? মূর্ছনা ভেদ!’

পণ্ডিত যশরাজ একটু থেমে শোনালেন, সা রে গা মা রে সা। রে গা…। সৃষ্টিকর্তার কৃপার কথা বললেন। ‘ওর কৃপা না হলে কিছু হয় না।…না মে গাতা হু, না তু সুনতে হে। ও-ই গাতা হু ও-ই সুনতে হে। (আমি গান গাই না। আপনিও শোনেন না। সৃষ্টিকর্তাই গায় সৃষ্টিকর্তাই শোনে)।’

সংগীতকে নেশা হিসেবে নেওয়ার পক্ষে পণ্ডিত যশরাজ। তবে পেশা হিসেবে নিয়ে কেউ কেউ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা করে সন্তুষ্ট—এমনটা শুনেই মাথায় হাত, ‘রাম রাম রাম।’

বাংলাদেশ সম্পর্কে যশরাজ বলেন, ‘এখানে জায়গায় জায়গায় সংগীত। বলা হয় ‘সাজা, বাজা, কেশ ইয়ে হে বাংলাদেশ।’ শিল্পীদের এখানে এতটা শ্রদ্ধা করে সবাই!’

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বরের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে রেওয়াজ করতে বলেন মেওয়াতি ঘরানার এই সংগীত বিস্ময়। বলেন, ‘তাহলে বয়স হলেও কণ্ঠটা কিছুটা হলেও বাগে রাখা যাবে।’

সংগীতে ভালো করতে হলে কী করতে হবে? ‘মা-বাবার সেবা করতে হবে। মা-বাবা সে কোই ভি বাড়া নেহি। তাঁদের মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখতে হবে। মা-বাবার তুষ্টি অর্জন করতে হবে। যেরকম তুষ্টি সেরকম আপনি দেখতে পারবেন।’ দেখতে পারবেন বলতে পণ্ডিতজী সংগীতচর্চাকে বুঝিয়েছেন।

এতটা জনপ্রিয়তা অর্জনের পরও নিজেকে খুব বড় শিল্পী মনে করেন না পণ্ডিত যশরাজ। শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘গুরুর খুব ভক্তি করেন। যা বলছে মেনে নেন। চোখ বুজে মানতে হবে গুরু যা বলেছেন ঠিক আছে। আর রেওয়াজ অভ্যস্ত হে। বিনা প্র্যাকটিস কুছ নেহি হোতা।’

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে ভারতীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণ বরাবরই উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে শিল্পীদের এগিয়ে আনতে হলে কী করতে হবে? বললেন, ‘সংগীত তো এভাবে আলাদা করা যাবে না। হ্যাঁ, ভারতে একটু ভালো পরিবেশ আছে। বাংলাদেশেও এটা হবে। বেঙ্গলের এই আয়োজনটাও একটি বড় ভূমিকা রাখবে।’

পণ্ডিত যশরাজ ২০০০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্মবিভূষণ লাভ করেন। পদ্মভূষণ পান ১৯৯০ সালে। আর পদ্মশ্রী লাভ করেন ১৯৭৫ সালে। সংগীত নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল ইন্ডিয়া মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসহ গান-বাজনায় আরো অনেক পদক পেয়েছেন তিনি। পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে যশরাজের মন্তব্য, ‘পুরস্কার দেওয়ার তুমি কে? সৃষ্টিকর্তা যেটা দিয়েছেন সেটাই তো বড় পুরস্কার।’

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ভারতের তরুণ সরোদ বাদক আবির হোসেন। তিনিও বাংলাদেশের সংগীত-শিল্পচর্চার বেশ প্রশংসা করেন। গুরুমুখী এই বিদ্যা প্রসারিত করতে বেঙ্গলের পরম্পরা সংগীতালয়ের কার্যক্রমেরও প্রশংসা করেন তিনি। গতকাল রাতে উেবর তৃতীয় দিনে সরোদ বাজিয়ে শোনান এই শিল্পী। তার ঝুলিতে রয়েছে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান যুব পুরস্কার ও সংগীত প্রভাকরণ স্বর্ণপদক।

 

View Full Article