Press Release – Day 1
শেষ হলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর প্রথম দিনের আয়োজন
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে পঞ্চমবারের মতো শুরু হলো পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে পাঁচদিনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে প্রদীপের আলোকচ্ছটায় অভিবাদন জানানো হয় দর্শকদের। শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় দলীয় নৃত্য। নৃত্যশৈলীর নানা ধারা রবীন্দ্রনাথে এসে মিলেছিল যে মোহনায়, তার উৎস ও পরম্পরা দিয়ে গাঁথা হয় পরিবেশনা “রবি-করোজ্জ্বল নৃত্যমালিকা”। উপস্থাপনার দ্বিতীয় অংশে ছিল মণিপুরী নৃত্য। এরপর একে একে ভরতনাট্যম, প্রদীপনাচ, রাধাকৃষ্ণ, পুংচালাম, ওড়িশি ও কত্থক আঙ্গিক, রবীন্দ্র নৃত্যভাবনা এবং বাংলাদেশে যে কটি শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রচলিত এবং চর্চিত সেগুলো অবলম্বনে নৃত্য পরিবেশন করেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল নৃত্যনন্দন।
পরিবেশন শেষে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।
প্রথম দিনের দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল প্রবীণ গোদখিণ্ডি ও রাতিশ টাগডের বাঁশি ও বেহালার যুগলবন্দী। তারা রাগ মারু বিহাগ ও হংসধ্বনি পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন রামদাস পালসুল।
পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি শাহ সৈয়দ কামাল।
দ্বিতীয় পরিবেশনা শেষে শাস্ত্রীয় সংগীতের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রয়াত শিল্পী বালমুরালি কৃষ্ণ ও ওস্তাদ
আলী আহমেদ হোসেনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের এ আসর শুরু হওয়ার মাত্র দুইদিন আগে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পী বালমুরালি কৃষ্ণ। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ আসরে শিল্পী বালমুরালি কৃষ্ণ তার মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেনের সানাই পরিবেশনা ছিল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের প্রথম আসরে।
এরপর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এমপি। মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের মান্যবর রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়ের।
প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘এবারের উৎসবের সবচেয়ে বড় অর্জন ৮৭ বছরের বিদুষী গিরিজা দেবীর পরিবেশনা।’ তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চাঙ্গসংগীত অনুধাবন করতে হলে কান প্রস্তুত করতে হয়। এর জন্য সময় লাগে। যার কান তৈরি হয়ে যায় সে কখনও হিংস্র হতে পারে না। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন এই উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারা।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘সকল অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এবারও এ উৎসব আয়োজিত হচ্ছে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ।’ তিনি হলি আর্টিজান, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণ করেন। বলেন, ‘এর প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের সংস্কৃতির ধারক, বাহক রুচিশীল মানুষদের। আমাদের সন্তানদের মাঝে বুনে দিতে হবে আমাদের সংস্কৃতির বীজ।’ সবশেষে হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে তারিক সুজার লেখা একটি কবিতা ‘জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’ আবৃত্তি করে শোনান।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের মান্যবর রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের অন্যতম বিশেষত্ব- প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান শিল্পীদের একই মঞ্চে এনে উচ্চাঙ্গসংগীতের দুয়ার সবার কাছে খুলে দিতে পারা। আমি বিশ্বাস করি, এই অনুষ্ঠান ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’
ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন বলেন, এরকম আন্তর্জাতিক উৎসবের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্বিত ব্র্যাক। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই মেধা ও মননের উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে ব্র্যাক এ উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।’
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, ‘এই উৎসবের সঙ্গে থাকতে পেরে স্কয়ার গ্রুপ গর্বিত।’
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়ের বলেন, ‘সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার প্রতি এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আমাদের এই উৎসব।’ খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিস্তারে তিনি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন যেন দেশের প্রতিটি গ্রামে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক ক্লাব করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেল যদি প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে উচ্চাঙ্গ সংগীতের জন্য বরাদ্দ করে তবে আমাদের উদ্যোগের মাধ্যমে যেসব শিল্পী তৈরি হবে তাদের কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন মানুষ যদি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে উচ্চাঙ্গসংগীত শোনে, তাহলে সে কখনও খারাপ কাজ করতে পারবে না।’
বক্তব্য শেষে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়ের সম্মানিত অতিথিদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উপস্থাপক ও সাংবাদিক মিথিলা ফারজানা।
উদ্বোধনি অনুষ্ঠানের পর রাগ যোগকোষে খেয়াল পরিবেশন করেন বিদুষী গিরিজা দেবী। এরপর রাগ মিশ্র খাম্বাজে ঠুমরী, রাগ কাফিতে টপ্পা ও রাগ মিশ্র গৌরিতে দাদরা পরিবেশন করেন তিনি। বিদুষী গিরিজা দেবীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন গোপাল মিশ্র, সারঙ্গিতে ছিলেন মুরাদ আলী খান, হারমোনিয়ামে সুমিত মিশ্র ও কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন সুনন্দা শর্মা। পরিবেশনা শেষে বিদুষী গিরিজা দেবী নিজের আঁকা চিত্রকর্ম উপহার দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়েরকে। সবশেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
পরবর্তী পরিবেশনা ছিল ওস্তাদ আশিষ খানের সরোদ বাদন। তিনি রাগ দরবারি কানাড়ায় আলাপ জোড় ঝালা বাজিয়ে শোনান। এরপর রাগ চন্দ্রনন্দন ও মিশ্র ভৈরবী রাগ পরিবেশন করেন। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ ও সরোদে ছিলেন সিরাজ আলী খান। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
প্রথম দিনের আয়োজনে এরপর খেয়াল যুগলবন্দি ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করেন বিদুষী অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর। অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে রাগ ললিত ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর পুরিয়া ধানেশ্রী পরিবেশন করেন একই সঙ্গে। এরপর রাগ দুর্গা পরিবেশন করেন অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে এবং সঞ্জীব অভয়ংকর পরিবেশন করেন রাগ ভূপালি। তাদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন আজিঙ্কা যোশি ও রোহিত মজুমদার। হারমোনিয়ামে সহযোগিতা করেছেন মিলিন্দ কুলকারনি ও তন্ময় দোচাকি। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
রাতের শেষ প্রহরে বেহালা পরিবেশন করেন ড. এল সুব্রহ্ম্যণন। শুরুতেই তিনি আদি তালম এ কৃতি বাজিয়ে শোনান। তাঁর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত তন্ময় বোস। ঘটমে ছিলেন টি এন রাধাকৃষ্ণান ও মৃদঙ্গমে লক্ষিনারায়ণ রঘুনাথান। এরপর তিনি আদি তালামে মোহানাম এবং ছন্দপ্রিয়া পরিবেশন করেন। ছন্দপ্রিয়া ড. এল সুব্রহ্ম্যণনের নিজস্ব সৃষ্টি। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়ের।
২৫ নভেম্বর দ্বিতীয় দিনের উৎসব শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। চলবে পরদিন ভোর ৫টা ১০ পর্যন্ত। দ্বিতীয় দিনের উৎসবে অংশ নেবেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগাল (ওডিশি নৃত্য), বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ (তবলা দলীয়), প্রিয়াঙ্কা গোপ (খেয়াল), রাহুল শর্মা (সন্তুর), মোহম্মদ শোয়েব ও অন্যান্য (দলীয় কণ্ঠসংগীত), পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায় (সেতার), পণ্ডিত উল্লাস কশলকার (খেয়াল) এবং পণ্ডিত রনু মজুমদার ও ইউ. রাজেশ (বাঁশি ও ম্যান্ডোলিন)।
সংগীত উপভোগের পাশাপাশি শ্রোতাদের জন্য খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে উৎসব প্রাঙ্গণে। এছাড়া বিভিন্ন স্টলে পাওয়া যাবে আইস মিডিয়ার ম্যাগাজিন, বেঙ্গল পাবলিকেশনসের বই। রয়েছে ডেইলি স্টার বুকস ও প্রথমা। এছাড়া অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে আরও রয়েছে অরণ্য, বেঙ্গল ক্রিয়েশনস, ম্যাংগো মোবাইল, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপ ও সেট্লমেন্ট এর প্রদর্শনী ‘আগামীর ঢাকা’। আছে ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ। সাংবাদিকদের জন্য থাকছে ওয়াইফাই জোন।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ। আয়োজন সর্মথন করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। অনুষ্ঠানে সম্প্রচার সহযোগী মাছরাঙা টেলিভিশিন। মিডিয়া পার্টনার আইস বিজনেস টাইমস। আতিথেয়তা সহযোগী র্যাডিসন হোটেল। সার্বিক সহযোগিতায় বেঙ্গল গ্রুপ। অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে বেঙ্গল ডিজিটাল, ম্যাংগো, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয় ও পারফেক্ট হারমনি প্রোডাকশনস্ সিঙ্গাপুরের সহযোগিতায়। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় ব্লুজ কমিউনিকেশনস।
গত চার বছর ধরে আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’ শিল্পী ও দর্শকের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশে তথা বিশ্বে র্সবাধিক বড় পরসিরে উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বছর উৎসবটি উৎর্সগ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশ্যে।