Press Release – Day 5
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭-এর শেষ দিনের অনুষ্ঠান
পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের ৫ম ও শেষ দিনের আয়োজন শুরু হয় ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে, ২৯ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যা ৭টায়।
শেষ দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় নৃত্য দিয়ে। বিদূষী সুজাতা মহাপাত্র মঞ্চ আলোকিত করেন ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। পরিবেশনাটি ছিল অর্ধনারীশ্বর ও রামায়ণ-লঙ- এ দুই পর্বে বিভক্ত। রাগমল্লিকা ও তালমল্লিকা ভিত্তিক প্রথম পর্ব অর্ধনারীশ্বরের কোরিওগ্রাফি ও নৃত্য রচনা করেছিলেন প্রয়াত পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র; সংগীত পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্রের।
ওড়িশি রামায়ণ থেকে নেওয়া দ্বিতীয় পর্ব রামায়ণ-লঙ-এর কোরিওগ্রাফিও প্রয়াত পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের করা; সংগীত পণ্ডিত ভূবনেশ্বর মিশ্রর। নৃত্যনাট্যটিতে সুজাতা মহাপাত্রের সহশিল্পী ছিলেন সৌম্য বোস, বাঁশিতে ছিলেন সৌম্যরঞ্জন যোশি, রূপক কে পারিদা, বেহালায় রমেশ চন্দ্র দাস, পাখোয়াজে একলব্য মুদুলি এবং আলোক সঞ্চালনায় জয়দেব দাস।
পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এমপি।
নৃত্য শেষে শুরু হয় বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সমাপনী অধিবেশন। এ অংশে এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক স্যার ফজলে হাসান আবেদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ছায়ানটের সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং আবাহনী লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী নাবিল আহমেদের পক্ষে তার মা আমিনা আহমেদ।
সভাপতির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া উচ্চাঙ্গসংগীতের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারে কাজ করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় প্রতি বছর এই উৎসব নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটাও গর্বের ব্যাপার। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারলে আরও ভালো লাগবে।’
প্রধান অতিথি স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘শিল্প-সাহিত্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ। তাই অনেক আশংকা কাটিয়ে এই উৎসব আয়োজন করতে পারা অনেক ইতিবাচক ব্যাপার।’
ছায়ানট বিদ্যায়তনের সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন বলেন, ‘উৎসব আমাদের জন্য খুব জরুরি। কিন্তু শুধুমাত্র ঢাকায় উৎসব আয়োজন করলে হবে না। সংগীত ও সংস্কৃতির এধরণের উৎসব সারা দেশে নিয়ে যেতে হবে। এধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের পল্লি গানের সুর তুলে ধরতে হবে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই আমাদের মধ্যে মমত্ববোধ জেগে উঠবে। কারণ, মানুষকে ভালোবাসতে পারাই মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ।’
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর আয়োজকসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘যে দেশের প্রধানমন্ত্রী এত বড় একজন সংগীত অনুরাগী সেদেশের সংগীত উৎসব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎসব না হয়ে পারে না। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব এখন বিশ্বের বৃহত্তম সংগীতের আসর।’
জেমকন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং আবাহনী ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী নাবিল আহমেদের পক্ষে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তার মা আমিনা আহমেদ। সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই উৎসবে সহযোগী হতে পেরে আবাহনী ক্লাবও গর্বিত। এই উৎসবের জন্য আবাহনী মাঠের দরজা পুনরায় খুলে দিতে আবাহনী ক্লাব প্রস্তুত। আমরা আশা করবো সামনে বছর উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব এখানেই আয়োজিত হবে।’
সমাপনী অধিবেশনের স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব আবুল খায়ের। তিনি অনুষ্ঠান আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং আয়োজনের সহযোগী সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। কিন্তু এই উৎসব আয়োজনের সব পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।’ সবশেষে তিনি বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা না থাকলে আমরা এই উৎসব আয়োজন করতে পারতাম না।’
আনুষ্ঠানিক সমাপনী অধিবেশনের পর আবার শুরু হয় বাদন পরিবেশনা। এবার মোহন বীণা পরিবেশন করেন পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। তিনি রাগ মরু বেহাগ ও ধুন পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেন সুভেন চ্যাটার্জি। পরিবেশনা শেষে পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্টের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
মোহন বীণার পর খেয়াল পরিবেশন করেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। তিনি রাগ যোগ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি একটি ঠুমরী পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেন শুভংকর ব্যানার্জি, এবং হারমোনিয়ামে গৌরব চ্যাটার্জি এবং তারপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী এসএম আশিক আলভি ও অপূর্ব কর্মকার। পরিবেশনা শেষে ব্রজেশ্বর মুখার্জির হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন সংগীত শিল্পী শামা রহমান ।
এরপর সেতারের যুগলবন্দি পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পিতা-পুত্র পণ্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণজিত দাস। তারা সেতারে যোগ কোষ পরিবেশন করেন। তাদেরকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত শুভংকর ব্যানার্জি। পরিবেশনা শেষে পণ্ডিত কুশল দাসের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম, এবং কল্যাণজিত দাসের হাতে শিল্পী অদিতি মহসিন।
যুগলবন্দি পরিবেশনার পর খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত কৈবল্য কুমার। তিনি রাগ গোরখ কল্যাণ ও খাম্বাজ রাগে ঠুমরী পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেন শ্রীধর মন্দ্রে, হারমোনিয়ামে ড. সুধাংশু কুলকার্নি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল কুমার মালাকার ও অভিজিৎ দাশ। পরিবেশনা শেষে পণ্ডিত কৈবল্য কুমারের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাদ আন্দালিব।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭-এর সমাপ্তি ঘটে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে। তিনি প্রথমে রাগ ললিত এবং পরে জনপ্রিয় লোকসুর পরিবেশন করেন। শিল্পীকে বাঁশিতে সঙ্গত করেন বিবেক সোনার ও ইউকা নাগাই, তবলাতে পণ্ডিত শুভংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, পাখোয়াজে পণ্ডিত ভবানী শংকর, এবং তানপুরাতে মুশফিকুর ইসলাম। পরিবেশনা শেষে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সংগীত উপভোগের পাশাপাশি পাঁচ দিনব্যাপী এ আয়োজনে খাবার ও পানীয়ের জন্য উৎসব প্রাঙ্গণে ছিল ফুড কোর্ট। পাশাপাশি উৎসব প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের সংগীত সাধক ও তাদের জীবনী নিয়ে একটি সচিত্র প্রদর্শনী এবং বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটলমেন্টস এর ‘সাধারণের জায়গা’ শীর্ষক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল ।
এ ছাড়া উৎসব প্রাঙ্গণে ছিল বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল এক্সপ্রেস, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়, অরণ্য, বেঙ্গল ভিজ্যুয়াল আর্টস প্রোগ্রাম, বেঙ্গল বই, ব্র্যাক ব্যাংক ও স্কয়ার গ্রুপের স্টল। ব্যাংকিং সেবায় ছিল ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ। সাংবাদিকদের জন্য ছিল ওয়াইফাই জোন।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭-এর নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ। আয়োজন সর্মথন করে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, মেডিক্যাল পার্টনার স্কয়ার হাসপাতাল, অনুষ্ঠানে সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল আই, মিডিয়া পার্টনার আইস বিজনেস টাইমস, আতিথেয়তা সহযোগী প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও। আয়োজন সহযোগী ইনডেক্স গ্রুপ, বেঙ্গল ডিজিটাল, বেঙ্গল বই ও বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় ছিলো ব্লুজ কমিউনিকেশনস। উৎসবের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলো পারফেক্ট হারমনি, সিঙ্গাপুর।
গত পাঁচ বছর ধরে আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’ শিল্পী ও দর্শকের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশ তথা বিশ্বের র্সবাধিক বড় পরিসরের উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বছর উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে।
উল্লেখ্য, এ বছর উৎসবের উদ্বোধন হয় ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায়। গত চার দিনে আসর মাতিয়েছেন ড. এল সুব্রহ্মন্যণ, আস্তানা সিম্ফনি ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা, বিদূষী পদ্মা তালওয়ালকর, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, পণ্ডিত উলহাস কশলকর, ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খাঁ, পণ্ডিত রণু মজুমদার ও পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোস, বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়করাম, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, কলা রামনাথ, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত যশরাজ, ওস্তাদ রাশিদ খান, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, ড. মাইসুর মঞ্জুনাথ, সাসকিয়া রাও দ্য-হাস, পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির মতো গুণীরা।